সরকার দেশের যানবাহন খাতকে পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন-নিম্ন করার লক্ষ্যে বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) ব্যবহার বাড়াতে নতুন নীতি প্রণয়নের পরিকল্পনা করেছে। শিল্প মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘জাতীয় বৈদ্যুতিক যানবাহন নীতি ২০২৫’ খসড়ায় ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো কেনা মোট যানবাহনের অন্তত ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎচালিত হওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
নীতির লক্ষ্য শুধু ইভি ব্যবহার বাড়ানো নয়, বরং পরিবহন খাতের কার্বন নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা এবং পরিচ্ছন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করাও। খসড়া নীতিতে সরকারি ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন বৈদ্যুতিক যানবাহন কেনার জন্য সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যাংক অর্থায়ন সুবিধা, যা আট বছরের মধ্যে কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য।
সম্পূর্ণ তৈরি ইভি-এর শুল্ক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো, রেজিস্ট্রেশন ফিতে ৫০ শতাংশ ছাড়, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন, কর টোকেন ও ফিটনেস সনদে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিকল্পনাও নীতিতে অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যানবাহন ধাপে ধাপে বন্ধ করার জন্য স্ক্র্যাপিং সুবিধা এবং জাতীয় ইভি চার্জিং নেটওয়ার্ক গড়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। চার্জিং স্টেশনগুলো শহর ও গ্রামে স্থাপন হবে, যেখানে সৌরশক্তি চালিত সুবিধার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নীতিতে একটি ‘ইলেকট্রিক ভেহিকল ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে, যার চেয়ারম্যান হবেন শিল্প উপদেষ্টা। কাউন্সিলে ৩২ জন সদস্য থাকবেন। এছাড়া, প্রচলিত যানবাহনের সর্বোচ্চ কার্যকরী আয়ু নির্ধারণ, অ-রেজিস্ট্রিকৃত বৈদ্যুতিক ত্রিচক্রযানগুলো (যেমন ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজি বাইক) আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন, এবং কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ইভি প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও করা হয়েছে।
স্থানীয় উৎপাদকদের ব্যাটারি, ব্রেকিং, লাইটিং ও অন্যান্য যন্ত্রাংশে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতার মানদণ্ড পূরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। লিথিয়াম-আয়ন ও সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি নিরাপদভাবে নষ্ট এবং পুনর্ব্যবহার করার নির্দেশনা পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী প্রণীত হয়েছে। নীতিতে স্থানীয় উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
তবে খসড়া নীতি নিয়ে শিল্পখাতের প্রতিনিধিদের মধ্যে উদ্বেগও আছে। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির বলেন, “নীতির কিছু অংশ সরাসরি কেবিনেট ডিভিশন থেকে নেওয়া হয়েছে, যা সংশোধনের সুযোগ রাখে নি। বৈদ্যুতিক যানবাহনের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর প্রস্তাব স্থানীয় উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সরাসরি ভোক্তা প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন, যেমন ভারতের, চীনের ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ।”
কবির আরও সতর্ক করেছেন যে ‘উৎপাদক’ ও ‘অ্যাসেম্বলার’ শব্দের অস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করতে পারে। তিনি বলেন, “শূন্য কার্বনের লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি শূন্য বেকারত্বও নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে চাকরি সৃষ্টি করাই মূল লক্ষ্য।”
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রশিদুল হাসান স্বীকার করেছেন, শিল্পখাতের প্রতিনিধিরা নীতির আমদানিভিত্তিক পদ্ধতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “নীতিটি এখনও খসড়া পর্যায়ে। কেবিনেট ডিভিশন থেকে আরও ইনপুট এসেছে। সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে নীতিটি সংশোধন করা হবে এবং পরে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় ও কেবিনেটে পাঠানো হবে।”

