বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক শিল্পকে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে টেক্সটাইল মিলগুলো দীর্ঘদিন বিনিয়োগ করেছে। তবে বর্তমানে সেই খাত বাঁচানোর জন্য মিল মালিকরা সরকারের কাছে জরুরি সহায়তা চাচ্ছেন। তাদের দাবি, স্থানীয় সুতা বিক্রিতে ১০ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা এবং সুতা আমদানিতে সেফগার্ড শুল্ক না দিলে শিল্পটি ধসের মুখে পড়বে।
গত তিন দশকে ২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের ফলে খাতটি সক্ষমতা বাড়িয়েছে। সুতি নিট সুতার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ এবং ওভেন সুতার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে এটি তৈরি পোশাক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিশেষত শেষ তিন মাসে সমস্যা আরও তীব্র আকার নিয়েছে। প্রায় ৫৮টি স্পিনিং ও ডাইং মিল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু মিল ভাড়া নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও বর্তমানে সেগুলোও কেবল আংশিকভাবে কার্যকর।
খাত বাঁচানোর জন্য শিল্প প্রতিনিধিরা চলতি মাসে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে জরুরি আলোচনা শুরু করেছেন। বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল ধাপে ধাপে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে খাতের দুর্দশার কথা জানিয়েছেন। রাসেল আরো বলেন, ‘আমাদের সদস্যদের ৫৮টি মিল ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ১ লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন।’
প্রণোদনা ও আমদানি শুল্কের আবেদন:
বিটিএমএ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিতে অনুরোধ করেছে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য সুতা উৎপাদনকারী মিলগুলোকে স্থানীয় বাজারে সুতা বিক্রির ওপর বর্তমান ১.৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হোক। চিঠিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, রপ্তানির জন্য দেশীয় মিল থেকে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ সুতা কেনা বাধ্যতামূলক হোক। পাশাপাশি মিল মালিকরা সুতা আমদানির ওপর সাময়িকভাবে সেফগার্ড ডিউটি আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল মিল মালিক ও বাণিজ্য সচিবের মধ্যে এসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিটিএমএর সহ-সভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, ‘আমরা তিনটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছি—১০ শতাংশ প্রণোদনা, স্থানীয় সুতা কেনা বাধ্যতামূলক করা অথবা আমদানির ওপর সেফগার্ড ডিউটি আরোপ।’ তিনি আরও জানান, সেফগার্ড ডিউটি আরোপের জন্য আইনি পরিবর্তনের প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি।’
চাহিদা কমায় সুতা জমে:
অন্তত আটজন স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকের সঙ্গে আলাপ অনুযায়ী, সরকারি প্রণোদনা হ্রাস, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং ভারতের বর্ধিত সহায়তা বাংলাদেশের মিলগুলোকে চাপে ফেলেছে। বন্ডেড এক্সপোর্ট স্কিমে শুল্কমুক্ত আমদানি এবং অবৈধ আমদানি আরও জটিলতা বাড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি কমায় স্থানীয় চাহিদাও কমেছে। ফলে অনেক মিল মালিক লোকসানে সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলসের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, ‘চাহিদা কমে যাওয়ায় আমাদের গুদামে সুতা রাখার জায়গা নেই। উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমাতে হয়েছে এবং কিছু কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, ২০২৬ সালের নভেম্বরে অন্তত ৫০ শতাংশ মিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’ শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান হোসেন মাহমুদ জানান, ‘চাহিদা কমায় বাইরে গুদাম ভাড়া করতে হচ্ছে।’
লোকসান ও রাজস্ব ক্ষতি:
একজন স্পিনিং মিল মালিকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি থেকে ৫৩-কাউন্টের সুতার দাম প্রতি কেজিতে ৬০ টাকা কমেছে। ফলে প্রতি কেজিতে ৪১ টাকা নিট লোকসান হচ্ছে। শুধু নভেম্বরেই ক্ষতি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পৌঁছেছে। লোকসান মিল মালিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সরকারের রাজস্বও কমেছে। স্থানীয় বাজারে সুতা বিক্রিতে প্রতি কেজিতে ৫ টাকা ভ্যাট আরোপিত, যা নভেম্বরের মধ্যে ৮ লাখ টাকায় নেমেছে।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়। ২০০৫ থেকে তৈরি পোশাক খাতকে সহায়তা করার জন্য শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলা হয়। শুরুর দিকে স্থানীয় মিলগুলো দেশীয় বাজারে সুতা বিক্রিতে ২৫ শতাংশ প্রণোদনা পেত। বর্তমানে এটি ১.৫ শতাংশে নেমেছে। স্থানীয় বিক্রিতে ভ্যাট ৫ শতাংশ, ইউটিলিটি ও ব্যাংক খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া টাকার অবমূল্যায়ন ও ইডিএফ তহবিল সংকোচন খাতকে চাপে ফেলেছে। রাসেল বলেন, ‘উৎপাদন খরচ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ হয়েছে। নগদ সহায়তা কমেছে।’
সালেউদ জামান খান যোগ করেন, ‘বাংলাদেশ নীতি সহায়তা কমাচ্ছে, আর ভারত নতুন প্রণোদনা চালু রাখছে।’ ভারতের রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন সুবিধায় প্রতি কেজিতে প্রায় ০.৩০ ডলার কার্যকর প্রাপ্তি পাচ্ছে। এর ফলে তারা বাংলাদেশে কম দামে সুতা বিক্রি করতে পারছে। বিটিএমএ জানিয়েছে, ভারত থেকে সুতা আমদানি ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
বিটিএমএ অনুসারে, টেক্সটাইল খাতে সরাসরি প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। ২০২২ ও ২০২৩ সালে খাতে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ছিল, তবে ২০২৪ সালের মন্দার পর তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিটিএমএ সভাপতি সতর্ক করে বলেন, ‘সরকার যদি প্রণোদনা না দেয়, মিলগুলো বন্ধ হবে। আমদানির উপর নির্ভরতা ফিরে আসবে। ইতিমধ্যেই ১ লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন।’ সংগঠনের তথ্যে দেখা যায়, স্পিনিং, উইভিং, ডাইং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং মিলসহ খাতে ১ হাজার ৮০০টির বেশি মিল রয়েছে, যার মধ্যে ৫২৭টি সুতা উৎপাদনকারী ইউনিট।

