সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গতি আনতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই)-এর প্রধানকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। দীর্ঘ এক দশক ধরে চলমান এই মামলাটি নিয়ে তদন্ত কার্যক্রমে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায়, হাইকোর্ট এ ধাপে এসে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে।
এই টাস্কফোর্সের গঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পুলিশের একজন প্রতিনিধি, যার পদমর্যাদা অ্যাডিশনাল ডিআইজি বা তার ওপরে, সিআইডির একজন প্রতিনিধি এবং র্যাবের একজন প্রতিনিধি। ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর হাইকোর্টকে টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি অবহিত করা হয়। এর আগে, ১৭ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
হাইকোর্ট গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক নির্দেশনায় মামলাটির তদন্ত ত্বরান্বিত করার জন্য এই টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল। পাশাপাশি, মামলার তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে দেয়ার আদেশও দেওয়া হয়েছিল। র্যাবের তদন্তে দীর্ঘ সময়েও সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি না হওয়া এবং তদন্তে রহস্যের জট না খুলে মামলাটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে আটকে থাকার প্রেক্ষাপটে আদালত এ সিদ্ধান্ত নেয়।
টাস্কফোর্সকে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ছয় মাসে টাস্কফোর্স কীভাবে তদন্ত চালাবে, কী ধরণের নতুন তথ্য বা প্রমাণ অনুসন্ধান করবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগীয় নজরদারির অধীনে এই ধরণের টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্তের গতি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে তদন্তের গুণগত মান এবং সততার ওপর।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন দেশের দুই প্রথিতযশা সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১২ বছর কেটে গেছে কিন্তু মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে তদন্তের দায়িত্ব পালন করেছে র্যাব, ডিবি এবং পুলিশসহ একাধিক তদন্তকারী সংস্থা কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
মামলাটি দীর্ঘসূত্রতায় নিমজ্জিত হওয়ায় সাংবাদিক মহল এবং সুশীল সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। মামলা সম্পর্কিত তথ্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরণের গুজব ও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। র্যাবের তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস হারিয়ে সাংবাদিক সমাজ বারবার দ্রুত বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।
টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে তদন্তে নতুন গতি আনা সম্ভব হবে বলে অনেকেই আশাবাদী। পিবিআই-এর মত একটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কমিটি, যেখানে অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিও থাকবেন, সেই তদন্তে কার্যকর পরিবর্তন আনতে পারে। তবুও প্রশ্ন রয়েই যায়—এত বছর পর এই টাস্কফোর্স কীভাবে নতুন প্রমাণ উদ্ঘাটন করবে? কী ধরণের কৌশল তারা গ্রহণ করবে, যাতে এতদিন ধরে চাপা থাকা সত্যের পর্দা ফাঁস হয়?
মামলাটির প্রতি জনমনে রয়েছে গভীর আগ্রহ এবং উদ্বেগ। বিশেষত, সাংবাদিক সমাজের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, যদি এই টাস্কফোর্সও সফল না হয়, তাহলে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া আর কখনোই আলোর মুখ দেখবে না।
সাগর-রুনির পরিবার, সহকর্মী ও দেশবাসী বিচার পেতে এখনও প্রতীক্ষায় আছে। টাস্কফোর্সের দায়িত্ব এখন সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ন্যায়বিচারের পথ সুগম করা।