বাংলাদেশের সমাজে নারী নির্যাতন আজও একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রণীত হওয়ার পরও নারীরা প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
বিশেষত- ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড হামলা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনা প্রতিনিয়ত সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে।
এ প্রবন্ধে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের কার্যকারিতা, চ্যালেঞ্জ, এবং সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে।
নারী নির্যাতনের বর্তমান প্রেক্ষাপট-
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গ্রামের দরিদ্র নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং শহুরে শিক্ষিত নারীরাও পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক নির্যাতনের আওতায় পড়ছেন।
যৌতুক, শিশু বিবাহ, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও পারিবারিক সহিংসতার ফলে নারীদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেক সময় সামাজিক লজ্জা বা ভয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার নারীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন, যা নির্যাতনের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়াকে কঠিন করে তোলে এবং বিচারের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ভূমিকা ও কার্যকারিতা-
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন” এবং পরবর্তীতে ২০১০ সালে “পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন” প্রণয়ন করে।
এই আইনগুলোর অধীনে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ করে, নারী নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
এর পাশাপাশি, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা তাত্ক্ষণিক আইনি সহায়তা পেতে পারেন।
এই আইনগুলোর মাধ্যমে সমাজে নারী নির্যাতন রোধে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতিত নারীরা থানায় মামলা করতে পারেন এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় ন্যায়বিচার পেতে পারেন।
এসব আইন নারীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হলেও এ ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
আইনের সীমাবদ্ধতা ও অপব্যবহার-
যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি কঠোর আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবু এর অপব্যবহার ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়।
কিছু ব্যক্তি ব্যক্তিগত বিরোধ বা সম্পত্তিগত দ্বন্দ্বে প্রতিশোধমূলক মনোভাব নিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ৮০ শতাংশ নারী নির্যাতনের মামলায় কোনো প্রমাণ মেলে না। যা তদন্ত প্রক্রিয়াকে জটিল করে এবং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেরি হয়।
আইনি প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে অনেক ভুক্তভোগী বিচার প্রাপ্তিতে হতাশ হয়ে পড়েন। অনেক সময় সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। তাই, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব-
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়। সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও মূল্যবোধের অভাব নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ। পরিবারে নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ হলে সমাজে নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে উঠতে পারে।
অনেক পরিবারে ছেলেমেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নারীদের অবমূল্যায়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের মধ্যে সম্মান ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করলে তারা নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সম্মানিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠবে।
আইন প্রয়োগে দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা-
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়ন এবং ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হতে পারে। নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত ও কার্যকরীভাবে নিষ্পত্তি করতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জরুরি।
সমাজের দায়বদ্ধতা ও নারীর প্রকৃত সুরক্ষা-
নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু মাত্র আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের দায়িত্ব নারীর প্রতি সম্মান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে সমতা, মানবিকতা এবং সহানুভূতির মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, ২০১০ নারীদের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এগুলো একমাত্র সমাধান নয়।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হলে তবেই এসব আইন প্রকৃত অর্থে কার্যকর হবে।
তবেই নারীরা সত্যিকারের সুরক্ষা অনুভব করবেন।