সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এক নতুন অধ্যায় রচনা হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো একজন দৃষ্টিহীন আইনজীবী, মো. মোশাররফ হোসেন মজুমদার, সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তার এই অর্জন কেবল এক ব্যক্তিগত সাফল্য নয়। এটি দৃষ্টিহীন ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সভাপতিত্বে এনরোলমেন্ট কমিটির এই তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্তে মোশাররফকে দেখা গেল আপিল বিভাগের আরও ৫৩ জন সিনিয়র আইনজীবীর কাতারে। তার অর্জনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি সমাজের বিভিন্ন স্তরেও দৃষ্টিহীনদের এই অগ্রযাত্রাকে সাধুবাদ জানানো হচ্ছে।
একান্ত আলাপচারিতায় মোশাররফ বলেন, “অনেক আগেই আমার সিনিয়র অ্যাডভোকেট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।” বিচারাঙ্গনে যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ ও অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান প্রধান বিচারপতি যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সিনিয়র অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্ত করেছেন। তার প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ।”
মোশাররফের জীবন সংগ্রাম ও শিক্ষাজীবন-
১৯৫৮ সালের ৬ জুন ফেনী জেলার এক গ্রামে জন্ম নেন মোশাররফ হোসেন মজুমদার। চার বছর বয়সেই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তার এই শারীরিক অক্ষমতা কখনোই তার ইচ্ছাশক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করেন।
১৯৭৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে মানবিক বিভাগে ১৯তম স্থান অর্জন করেন তিনি। এর পর ঢাকার আইনজীবী মহলকে চমকে দিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে, যেখানে তিনি প্রথম দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলভাবে স্নাতক শেষ করার পর তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং তার কর্মজীবন শুরু করেন।
পেশাগত জীবন ও অবদান-
১৯৮৫ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, শারীরিক সীমাবদ্ধতা কোনোভাবেই মানুষের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরপর ১৯৮৯ সালে হাইকোর্ট এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত হয়ে তিনি আইনপেশায় তার মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে একটি স্থায়ী আসন করে নেন।
তবে তার কাজ শুধু আদালত পাড়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে শিক্ষকতা করছেন এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দৃষ্টিহীন বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য আইন প্রণয়নে তার অবদান সমাজে একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
চোখের আলো নিভে গেলেও মন ও মেধার আলোয় তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজেকে এক উজ্জ্বল উদাহরণে পরিণত করেছেন। তার এই অর্জন প্রমাণ করে, ইচ্ছাশক্তি এবং অধ্যবসায় মানুষকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, যা সাধারণত কল্পনাতীত। দৃষ্টিহীন আইনজীবী হিসেবে তার এই সাফল্য আমাদের সমাজকে এক নতুন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করবে এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।