শাসকের ক্ষমতার অবধারিত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার। এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার যুগে যুগে পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্র ও সমাজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের এই ভয়াবহ প্রভাব থেকে রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের রক্ষায় ২৩৮ বছর আগে ১৭৮৭ সালে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি (Principles of Separation Of Powers) উদ্ভব হয়। যা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এ নীতি অনুসারে সরকারের ক্ষমতা তিনটি সমান ভাগে বিভক্ত- আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ। এই তিনটি বিভাগেরই ক্ষমতা সমান কিন্তু ভিন্ন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানের পবিত্র অঙ্গীকার। মাজদার হোসেন মামলায় এই পবিত্র অঙ্গীকারকে আরও বেশি সুষ্পষ্ট করা হয়েছে। আমাদের সরকার ও নীতি নির্ধারকরাও বিচার বিভাগের প্রতি এই অঙ্গীকার মুখে মুখে সর্বত্র প্রচার করে বেড়ায়। প্রকৃত পক্ষে এটা তাদের একটা শুভংকরের ফাঁকি। কারণ রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগের বাজেটের দিকে তাকালেই আমরা দেখি যে, অন্য দুই বিভাগের তুলনায় কি প্রকট বাজেট বৈষম্যের শিকার বিচার বিভাগ। পৃথিবীতে বোধহয় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে সে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বিচার বিভাগের বাজেট রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল বিটিভি এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেটের চেয়েও কম।
বর্তমানে সারাদেশের আদালতে মামলার জট অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সারাদেশের সব আদালতে বর্তমানে মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩ টি। ২০০৭ সালের ১লা নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় সারা দেশের আদালতে মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। অর্থাৎ গত দেড় যুগে মামলা বেড়েছে তিনগুণ কিন্তু বিচারকের সংখ্যা ও বিচার বিভাগীয় অবকাঠামোর তেমন কোনো উন্নয়নই হয়নি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ হাজার ১২০ টি। আর আপিল বিভাগে মাননীয় বিচারপতি রয়েছেন মাত্র ০৭ (সাত) জন। অর্থাৎ আপিল বিভাগের একেকজন বিচারপতির কাঁধে ৪৪৪৬ টি মামলার বোঝা। আর দেশে ১৭ কোটি জনসংখ্যার হিসেবে ২ কোটি ৪৩ লাখ মানুষের বিপরীতে মাত্র ১ জন আপিল বিভাগের বিচারপতি রয়েছেন।
হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১ টি। হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে মাননীয় বিচারপতি রয়েছেন ৮৮ জন। অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগের একেকজন বিচারপতির কাঁধে ৬৭০১ টি মামলার বোঝা। আর জনসংখ্যার হিসাবে ১৯ লাখ ৩২ হাজার মানুষের বিপরীতে একজন হাইকোর্টের বিচারপতি রয়েছেন।
বর্তমানে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২ টি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে অধস্তন আদালতের বিচারক রয়েছেন মাত্র ২২০০ জন। সে হিসেবে অধস্তন আদালতের একেকজন বিচারকের কাঁধে ১৭৭১ টি মামলা। আর জনসংখ্যা হিসেবে ৭৭,২৭৩ জন মানুষের জন্য একজন অধস্তন আদালতের বিচারক রয়েছেন। আবার অধস্তন আদালতের বিচারকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রেষণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। সে হিসেবে বিচারকের সংখ্যা আর বিচারের অবস্থা আরও প্রকট। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বিচার বিভাগের এই করুণ পরিসংখ্যান সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, আগামী ৫০ বছরেও মামলার জট থেকে বিচার প্রার্থীরা মুক্তি পাবে না। জনগণের ন্যায় বিচারের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি, আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্যবার পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগের কথা বলেছেন। কিন্তু বাজেট স্বল্পতার কাল্পনিক অজুহাতে তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কখনো নেয়া হয়নি।
বিচার বিভাগের অবকাঠামো ও লজিস্টিক সংকট আরও ভয়াবহ। দেশের অধস্তন আদালতে বিচারের জন্য স্টেনোগ্রাফারের মত অতি প্রয়োজনীয় পদে নিয়োগ দেয়া হয় না। অধস্তন আদালতের বিচারিক পরিবেশ কোনোভাবেই যুগোপযোগী নয়। অনেক বিচারকই হাতে রায় এবং আদেশ লিখতে বাধ্য হন। কারণ কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্টেশনারি ও প্রয়োজনীয় জনবলের প্রকট সংকট। অথচ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাগণের সুযোগ-সুবিধা সিনিয়র সহকারী জজ ও যুগ্ম জেলা জজের চেয়েও অনেক বেশি।
দেশের বেশিরভাগ অধস্তন আদালতে বিচার প্রার্থীরা ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাধি হতে বঞ্চিত। ছোট এজলাস বা বারান্দায় কোথাও বিচারপ্রার্থীদের বসার স্থান নেই এবং কোথাও কোথাও দাঁড়ানোর জায়গাও অপ্রতুল। এজলাসে অনেক সময় আইনজীবীদেরই বসার স্থান সংকুলান হয় না। প্রচন্ড গরমে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী সবাই হাঁসফাঁস করতে থাকে। যেখানে প্রচন্ড গরমে এজলাসে খোদ বিচারকই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন সেখানে বিচার প্রার্থী জনগণ আর আইনজীবীদের করুণ অবস্থা সহজে অনুমেয়। খোদ জেলা জজদের বিচার কক্ষগুলো গরমে অসহনীয় হয়ে ওঠে। অথচ অনেক মন্ত্রণালয়ের কনিষ্ঠ কর্মচারীদের কক্ষও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তীব্র গরমে সারাদেশের বিভিন্ন আদালতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়া নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েছেন যা বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এদেশে খোদ প্রধান বিচারপতির এজলাসেই বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে ভাঙা ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি এজলাসে পড়ার কারণে। এত কিছুর পরেও সরকার নিশ্চুপ ও নির্বাক, এ যেন দেখেও না দেখার, জেনেও না জানার ভান করা। যদিও দেশের বিভিন্ন জেলায় বিচারপ্রার্থীদের বিশ্রামের জন্য ন্যায়কুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপর্যাপ্ত।
আদালতের অধিকাংশ নতুন ভবনই থাকে ব্যবহার অনুপযোগী। এগুলোতে কোনোভাবেই স্থান সংকুলান হয় না। নতুন নির্মিত ভবন দেখলে মনে হয় দেশটির জনসংখ্যা বড়জোর পাঁচ কোটি। একেকটি এজলাস এতই ছোট আকারে বানানো হয় যে তা দেখে মনে হবে পরোক্ষভাবে সবাইকে একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে যেন ‘আদালতে বিচার চাইতে আসা এক ধরনের অপরাধ’।
বাজেটের অর্থ ব্যয়ে বিচার বিভাগে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছতা রয়েছে, অথচ বিচার বিভাগ নজিরবিহীন বাজেট বৈষম্যের শিকার। প্রতিবছর মামলা দায়েরের কোর্ট ফি বাবদ সরকার বিপুল অর্থ আদায় করে। কিন্তু তার সুফল স্বয়ং বিচার বিভাগই পায় না।
রাজধানী ঢাকায় মহানগর দায়রা আদালতে লক্ষাধিক চেকের মামলা বিচারের জন্য মাত্র সাতটি যুগ্ম দায়রা জজ আদালত আছে (দৈনিক যুগান্তর, ৭মার্চ ২০২৫)। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগ্ম দায়রা জজের আদালতেই শুধু চেকের মামলাই বিচারাধীন রয়েছে ১৪,২৮৬ টি। এক মাসে কার্যদিবস হিসেব করলে একেকজন বিচারককে প্রতিদিন ৬৫০ টি মামলা শুনতে হবে। এতে সহজেই অনুমেয় বিচার বিভাগকে কীভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে এবং কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, কক্সবাজারসহ দেশের ১০৭ টি আদালতে বিচারকদের নিজস্ব এজলাসই নেই। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়। অথচ ১৮ বছরেও নিজস্ব প্রশাসন তৈরি হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে প্রায় ৩০০ পদ শূন্য। অনেক ক্ষেত্রেই অন্য আদালতের বিচারককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে আরেক আদালত ও ট্রাইবুনালের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
সারাদেশে জমির মালিকানা নিয়ে প্রায় ৪ লাখ মামলা বিচারাধীন। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের ৭৩ বছর পর ২০২৩ সালে সরকার ৫৪ জেলায় প্রথমবারের মতো ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল গঠন করে। সেটাও নিজ উদ্যোগে নয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্টের নির্দেশেরও কয়েক বছর পরে। হাইকোর্ট ৯০ দিনের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল গঠনের নির্দেশ দিলেও তা গঠন করা হয় তিন বছর পর। এখানেই শেষ নয়। কাগজে কলমে ৫৪ টি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল গঠন করা হলেও মাত্র ১৩ টিতে বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অসংখ্য বিচারপ্রার্থী মানুষের সাথে বিচারের নামে রাষ্ট্রের কি নির্মম প্রহসন!
বর্তমানে ভূমি জরিপ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন মামলা ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৭০ টি। আর আপিল ট্রাইবুনালে বিচারাধীন মামলা ৮ হাজার ৫১২ টি। আইন, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষ্ঠুর লালফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত। সারাদেশে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধে প্রতিদিন যে অসংখ্য প্রাণহানি ও সহিংসতা ঘটে তার আর্থিক মূল্য ও সুদূর প্রসারী প্রভাব কি দিয়ে মাপবেন নীতিনির্ধারকেরা? বিচার বিভাগকে বিকশিত হতে না দেয়ার এই আত্মঘাতী কার্যক্রমের ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রে কত ভয়াবহ তার কোনো পরিসংখ্যান কি তাদের কাছে আছে?
বিচার বিভাগের এই করুন চিত্রের মূলে রয়েছে এর জন্য পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব। বাজেটের যাঁতাকলে মূলত ইচ্ছাপূর্বক বিচার বিভাগকে সক্ষমতা অর্জন করতে দেয়া হচ্ছে না। এটা মূলত সুনিপুণ নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা। প্রতিবছর বাজেটে প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়ে শুধু বিচার বিভাগের জন্যই কমে। বিগত কয়েক দশক ধরে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকে মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটের সাথে তুলনা করলে বিচার বিভাগের বাজেট লজ্জা ও হতাশার।
বিগত ২৪ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিচারের ব্যয় নির্বাহ হয়। তখন বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১২৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৩৭০ শতাংশ। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৬ কোটি টাকা। ২০০১-০২ অর্থবছরে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের (বিচার বিভাগ) জন্য পৃথক বরাদ্দের ব্যবস্থা চালু করে সরকার। ওই অর্থবছরে আইন বিভাগের জন্য ১৪৮ কোটি ও সুপ্রিম কোর্টের জন্য ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৩৭৮ শতাংশ। উন্নয়ন খাতে কোনো বরাদ্দ ছিল না। এই খাতে প্রথম বরাদ্দ হয় ২০১২-১৩ (সংশোধিত) অর্থবছরে। তখন মোট বরাদ্দ ছিল ৭৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৬৬৪ কোটি এবং সুপ্রিম কোর্টের জন্য ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। উন্নয়ন খাতে ছিল ১২ কোটি টাকা। এটিও মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার ২২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। এখানে সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২৪৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
এ দেশে কয়েক কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে বিপুল উৎসাহে যে বাজেট দেয়া হয় পুরো বিচার বিভাগের জন্য সে বাজেট দেয়া হয় না। এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। ঢাকা-সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ১১৫ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের একাংশ চার লেন করতে নেওয়া প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৩০৬ কোটি টাকা। এর আগে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেন করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। ২০০৯- ১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অধীন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর মতে, এই বিপুল বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
বিচার বিভাগের প্রতি রাষ্ট্রের এই নজিরবিহীন বৈষম্যের খেসারত দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রেরই প্রকৃত মালিক নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিচার বিভাগের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতিরও কখনো কোনো সমন্বয় করা হয় না। আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (JATI) এর মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাস্যকর বাজেট দেয়া হয়। যা খুচরা বরাদ্দ নামেও পরিচিত। বিচারকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (JATI) অর্থের অভাবে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। অধস্তন আদালতের বিচার পরিচালনায় গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। তীব্র মামলার জট থাকলেও উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগে পর্যাপ্ত কোন অর্থ বরাদ্দ হয় না। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যার স্থায়ী আইন কর্মকর্তা নেই। এখানে আইনজীবীদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাই নেই। বিচার বিভাগে আইনজীবীদের অবস্থা আরও করুণ।
২০১৫-২০১৬ ও ২০১৬-২০১৭ এই দুই অর্থবছরে সুপ্রিম কোর্টের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ শূন্য টাকা। বিচার বিভাগের প্রতি তীব্র অবহেলা এতে সহজেই অনুমেয়। এখানে কাগজ কলমে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু বাজেট দিয়ে বিচার বিভাগকে চেপে ধরা হয়েছে। বিগত সময়ে ফৌজদারি মামলা, রিমান্ড ইত্যাদি ইস্যুতে বিচার বিভাগের উপর বেআইনী হস্তক্ষেপ এই কৌশলী নিয়ন্ত্রণকেই বারবার সামনে এনেছে। এর ভয়ংকর প্রভাব পড়েছে পুলিশসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপরেই। এ সময়ে ফৌজদারি মামলা গ্রহণ, রিমান্ড ও জামিনে বিচার বিভাগের উপর নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে দিয়েছে বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়।
পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণে সংবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ বিচার বিভাগের সর্বজন স্বীকৃত ক্ষমতা (আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২)। অথচ এখানে বাজেটের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে বিচার বিভাগের এই পবিত্র ক্ষমতাকেও সংকুচিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলমান। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়নে বিচার বিভাগ, আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। নির্বাহী বিভাগের আদেশেই বিচার বিভাগের বাজেট হয়। সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ও বিচারপ্রার্থী মানুষের সাথে এ এক অদ্ভুত তামাশা।
এই অঞ্চলে আমরাই বোধহয় একমাত্র দেশ যার অ্যাটর্নি সার্ভিস, প্রশিক্ষিত আইনজীবী বা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব আইনজীবী নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকরা প্রেষণে এসে আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন। এই অদ্ভুত ব্যবস্থা আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ন্যায়বিচারের জন্য অনেক বড় হুমকি।
উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের বেতন নিয়েও আছে তীব্র বৈষম্য। অদ্ভুতভাবে বিচারকাজে নিয়োজিত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও সদ্য নিয়োগ পাওয়া নতুন বিচারপতি উভয়েরই বেতন-ভাতা সমান। দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত অভিজ্ঞ বিচারপতিদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার আর্থিক মূল্য দিতে সরকারের প্রচন্ড অনীহা। এমনকি খুবই অদ্ভুতভাবে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের গবেষণা বা বিদেশ ভ্রমণেও কোনো অর্থ বরাদ্দ থাকে না। জনগণের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে লিগ্যাল এইড সারা বিশ্বে কার্যকর ও স্বীকৃত পন্থা হলেও দেশে কৃত্রিম বাজেট স্বল্পতায় লিগ্যাল এইড সার্ভিসকে কার্যত অকার্যকর করে রেখেছে।
বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল বাজেটের জন্য এই বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের মুখ চেয়ে থাকতে হয়। বাজেট প্রণয়নে বিচার বিভাগের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। নির্বাহী বিভাগ যে বরাদ্দ দেয় তা দিয়েই বিচার বিভাগকে চলতে হয়। বাজেট প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিচার বিভাগ পরনির্ভরশীল, দুর্বল ও ভঙ্গুর। বাজেট দিয়ে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের প্রতি বড় হুমকি। বিচার বিভাগের হাতে বাজেটের স্বাধীনতা না থাকলে আদালত কখনোই পরিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন হতে পারবে না। এটা বিগত সময়ে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃত আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।
পৃথিবীর অনেক আন্তর্জাতিক দলিলে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার তাগাদা সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। UDHR, ICCPR, European Convention, American Convention, African Charter সহ অনেক আন্তর্জাতিক দলিলই বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৮১ সালে আন্তঃমহাদেশীয় প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে গৃহীত ‘সিরাকাস নীতি’ র ২৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগ নিজেই নিজের বাজেট করবে। পর্যাপ্ত বাজেটে আদালত তার কার্যক্রম চালাবে’। ১৯৮২ সালে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন দিল্লী ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, বিচার বিভাগ পর্যাপ্ত বাজেটে পরিচালিত হবে। ১৯৮৩ সালে মন্ট্রিয়লের বিশ্ব বিচারপতি সম্মেলনের সমাপনী ঘোষণায় বলা হয়, আদালতই বিচার প্রশাসন চালাবে। আর পর্যাপ্ত অর্থের জোগান দেয়া হবে রাষ্ট্রের “Priority of the Highest Order“। ১৯৮৫ সালের জাতিসংঘের মিলান কংগ্রেসে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র আদালত চালাতে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত বিচারপতি ও আইনজীবীদের সম্মেলনে গৃহীত লুসাকাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, বিচারিক কর্মকর্তা ও তাদের সহায়ক কর্মচারীর সংখ্যা পর্যাপ্ত হতে হবে। বিচার বিভাগের সবটুকুর উপর কর্তৃত্ব থাকবে প্রধান বিচারপতির।
জাতিসংঘের ৪৫ তম অধিবেশনে বলা হয়, বিচার প্রশাসনের চাহিদামতো বাজেট বরাদ্দ দেয়া হবে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ১৯৮৫ সালের টোকিও নীতি, ১৯৯৩ সালের প্রধান বিচারপতিদের কলম্বো সম্মেলন ও ১৯৯৫ সালে বেইজিং যে অনুষ্ঠিত প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলন সর্বত্রই বিচার বিভাগের বাজেটের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এর সুস্পষ্ট অর্থ হল, আদালতই তার বাজেট প্রণয়ন করবেন, আদালতই তার নিজস্ব প্রশাসন চালাবেন। আদালতকে পর্যাপ্ত বাজেট প্রদান করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আদালতের উপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা ও অর্থও তাই। আদালতই বিচার বিভাগের বাজেট করবে এবং সেই বাজেট বাস্তবায়ন করবে। নির্বাহী বিভাগের কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়নের। অথচ আদালতকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে যা পুরোপুরি অসাংবিধানিক। এটা মূলত আইনের শাসনের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতির বিরুদ্ধ। দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে এই অসাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগের প্রভাব ভয়াবহ, যা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান ও সুস্পষ্ট।
জাপানের মতো কম অপরাধপ্রবণ ও উন্নত দেশে ১২ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারক আছেন ৪ হাজার। ভারতে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারক ২১ জন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারক আছেন ১৫০ জন। ফ্রান্সে মোট বিচারক ৭৭০০ জন এবং জনসংখ্যা ৬ কোটি ৬৬ লাখ। রাশিয়ায় ১৪ কোটি ৪১ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা প্রায় ৩৩,০০০। আর পাকিস্তানে ২০ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারক আছেন ৪ হাজার জন। উন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিচার বিভাগের অবস্থা শোচনীয়।
আমাদের বাজেটের আকার, বিভিন্ন প্রকল্পে খরচের নানা পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট যে, বিচার বিভাগ ও বিচার কাজে বাজেট বরাদ্দে আমাদের সরকারের তীব্র অনীহা রয়েছে। বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও বিচারপ্রার্থীদের আস্থা অর্জনে বাজেটের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অন্যতম প্রধান শর্ত। সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃত ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিতে স্বাধীন বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বাস্তবতায় বাজেটের পূর্ণ স্বাধীনতা বিচার বিভাগের কার্যকারিতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে। যদি প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশে আমরা আসলেই বিশ্বাস করি তাহলে বিচার বিভাগ নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
বিচার বিভাগকে অকার্যকর ও দুর্বল করে রাখলে সমাজ ও রাষ্ট্রে সহিংসতা, অস্থিরতা জ্যামিতিক হারে বাড়ে। এতে অদৃশ্য শক্তি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর প্রভাব গভীর ও ভয়াবহ। উন্নয়ন দিয়ে, চাকচিক্য দিয়ে যে ন্যায়বিচারের ক্ষত ঢাকা যায় না তা ইতোমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এখানে কোটি কোটি বিচার প্রার্থী ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য সংগ্রামরত। আর খোদ বিচার বিভাগই নিজের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সংগ্রামরত। তাহলে ন্যায় বিচার আসবে কোথা থেকে? আইনের শাসনের শেষ আশ্রয় বিচার বিভাগ এই করুন বাস্তবতা নিয়ে কীভাবে জনগণের ‘অ্যাক্সেস টু জাস্টিস‘ নিশ্চিত করবে? নির্বাহী বিভাগের কাছে বাজেটের নিয়ন্ত্রণ রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দাবি করা দেশ ও জাতির সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাজু হাওলাদার পলাশ
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
০১৭১৮০৬৭৪৯৮। blackandwhite.lawhouse@gmail.com