প্রতি বছর হাজার হাজার আইন স্নাতক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বার কাউন্সিলে শপথ নিয়ে অ্যাডভোকেট হিসেবে আদালতে পা রাখেন কিন্তু মাত্র দুই-তিন বছরের মধ্যেই অনেকে নিরবে পেশা ছেড়ে বেরিয়ে যান। এই তরুণ আইনজীবীরা হতাশ, প্রস্তুতিহীন এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। কেউ কেউ চিরতরে বাদ দেন লিটিগেশন পেশা।
এই ‘বহির্গমন’ বা পেশা ত্যাগের পেছনে কারণগুলো অনেকটাই চেনা:
- অপ্রতুল সম্মানী
- গাইডলাইন বা মেন্টরশিপের অভাব
- ব্যবহারিক শিক্ষার অভাব এবং
- আইনি শিক্ষার সঙ্গে পেশাগত বাস্তবতার গভীর বিচ্ছিন্নতা
মূল সংকট প্রতিভার নয়, প্রস্তুতির। বর্তমান আইনি শিক্ষা কাঠামো তরুণদের ‘কোর্টরুম-প্রস্তুত‘ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারলেই পরিবর্তনের পথ খুলবে। অন্যান্য অনেক পেশার মতো নয় আইন। এটি কেবল চাকরি নয়, এক ধরনের ডাকে সাড়া দেওয়া। এখানে প্রয়োজন আইনি জ্ঞানের পাশাপাশি বিচারিক প্রক্রিয়া বোঝা, উপস্থিত বুদ্ধি, বক্তব্যের দক্ষতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক দৃঢ়তা।
এই গুণগুলো বই পড়ে শেখা যায় না। এগুলো শেখা যায় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে- পর্যবেক্ষণ ও অভিভাবকত্বের (মেন্টরশিপ) মাধ্যমে। বিশেষ করে লিটিগেশন বা মামলা পরিচালনার কাজ মানসিক ধৈর্যের পরীক্ষা। এখানে তাত্ক্ষণিক ফল নেই। নবীন আইনজীবীরা বিচারক, ক্লায়েন্ট বা আদালতের সহানুভূতির সুযোগ পান না। শহুরে কাঠামো বা পরিবারে আইনি পটভূমি না থাকলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়।
সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই সমাধান হলো: আইন শিক্ষার শুরু থেকেই নিয়মিত চেম্বার ইন্টার্নশিপ চালু করা। প্রথম সেমিস্টার থেকেই শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অ্যাডভোকেটদের অধীনে কাজ করবেন, দিনে ক্লাস, রাতে হাতে-কলমে শেখা। গড়ে মাসে ১৫ দিন কাজ করলে ৫ বছরে প্রায় ৬০০ দিনের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব, যা বছরের শেষে সাময়িক ইন্টার্নশিপের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর।
এই সময়েই শিক্ষার্থীরা শিখবে:
• মামলা পরিচালনার ছন্দ
• ড্রাফটিং কৌশল
• ক্লায়েন্ট ব্যবস্থাপনা
• আদালতের আদবকায়দা ও কৌশল
• এবং প্রফেশনাল আচরণ
তাদের এই পেশা ত্যাগ কোনো অলসতার নয়, বরং কাঠামোগত সংকটের ফল। মূল কারণগুলো হলো:
• দীর্ঘ সময় কাজ, তবু কোনো বেতন নেই
• গাইড বা মেন্টরের অভাব
• পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল
• ক্লায়েন্ট, ড্রাফটিং ও মৌখিক শুনানিতে অনভিজ্ঞতা
• অর্থনৈতিক চাপ, বিশেষ করে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য।
অনেক আইন কলেজ আবার বাস্তব প্রশিক্ষণের চেয়ে গবেষণা ও বিতর্কে বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে বাস্তব আদালত পরিবেশের সঙ্গে তার মিল খুবই কম।
একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর চেম্বারই হতে পারে তরুণদের বাস্তব প্রশিক্ষণের শ্রেষ্ঠ জায়গা, সেখানে:
• প্রতিদিন ড্রাফট তৈরি হয়
• কৌশল ঠিক হয়
• ক্লায়েন্টদের পরামর্শ দেওয়া হয়
• এবং আইন বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মেলানো হয়
নিয়মিত ইন্টার্নশিপে শিক্ষার্থীরা শিখবে:
• ফাইল করা
• কারণ তালিকা পরিচালনা
• আদালতের প্রক্রিয়া
• ক্লায়েন্ট ও আদালত কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ
• বাস্তব পেশার চ্যালেঞ্জ ও প্রাপ্তি। আগে সিনিয়ররা নিজেরাই আগ্রহ নিয়ে জুনিয়রদের সাহায্য করতেন। এখন আইন শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধিতে তা আর সম্ভব নয়।
তাই মেন্টরশিপকে আনতে হবে কাঠামোর মধ্যে:
• ১০ বছরের অভিজ্ঞ সিনিয়রদের মেন্টর হিসেবে উৎসাহিত ও প্রয়োজনে পুরস্কৃত করা
• বার অ্যাসোসিয়েশন ও আইন কলেজের যৌথ প্ল্যাটফর্মে ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা
• ডিজিটাল লগবুক, মাসিক পর্যালোচনা ও একাডেমিক ক্রেডিট যুক্ত করা
এই সংস্কারের দায় একা শিক্ষার্থীর নয়। আইন কলেজকে অবশ্যই সিলেবাসে নিয়মিত চেম্বার ইন্টার্নশিপ যুক্ত করতে হবে। বার কাউন্সিলকে মেন্টরশিপ গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। সিনিয়রদের এটা দায়িত্ব হিসেবে দেখতে হবে, ভবিষ্যতের আইনজীবী গড়ার। হাইকোর্ট ও স্টেট লিগ্যাল সার্ভিস কর্তৃপক্ষ মেন্টরদের স্বীকৃতি দিতে পারে। এসব উদ্যোগ কম খরচে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য।

আইন পেশা কেবল চাকরি নয়, এটি আদালতের একটি অঙ্গ। তরুণ আইনজীবীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না পেলে তা বিচারপ্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে, ন্যায়বিচার ব্যাহত হয় এবং জনগণের বিশ্বাস হারায়। প্রথম দিন থেকেই চেম্বারে বাস্তব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা মানেই বিচারব্যবস্থাকে রক্ষা করা। যেকোন রাষ্ট্রের প্রয়োজন শুধু আইনজীবী নয় বরং দক্ষ, নৈতিক, প্রস্তুত আইনজীবী- যারা আদালতের বাস্তবতায় অভ্যস্ত। এই প্রস্তুতি শুরু হোক আইন শিক্ষার প্রথম দিন থেকেই।
- প্রত্যেক চেম্বার হোক ব্যবহারিক শ্রেণিকক্ষ
- প্রত্যেক সিনিয়র হোন একজন মেন্টর
- প্রত্যেক শিক্ষার্থী জানুক একটি মামলার বাস্তব ওজন
মাত্র ১৫ দিন প্রতি মাস চেম্বারে কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা যেন ‘পেশা ছাড়তে নয়’, আদালতের কক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারেন। আমরা যেন তরুণ আইনজীবীদের পতন নিয়ে নয়, তাদের উত্তরণ নিয়েই আলোচনা করতে পারি।
সূত্র: সংবাদ মিটার