জুলাই সনদে প্রস্তাবিত ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য অন্তত এক ডজন নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আটটি আইন সংশোধনের প্রয়োজন হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা বলেন, এসব আইন প্রয়োজন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং দীর্ঘদিনের আইনি ঘাটতি পূরণে। রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমা, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনারদের আচরণবিধি, বিচার বিভাগের প্রশাসনিক স্বাধীনতা এবং স্বাধীন অপরাধ তদন্ত সংস্থা গঠনের জন্য আইন প্রণয়নে একমত হয়েছে।
তারা আরও একমত হয়েছে যে, যেসব সংস্কারের জন্য সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রয়োজন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। যাতে দেশ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খেয়ালখুশি মতো পরিচালিত না হয়।”
নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব:
সনদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি যেকোনো দণ্ড মাফ বা কমানোর ক্ষমতা রাখবেন। তবে এটি নতুন আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী হবে এবং ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারীর পরিবারের সম্মতি বাধ্যতামূলক।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ইফতেখারুজ্জামান জানান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার, বিচারক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনে সংশোধনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নতুন আইন ও আচরণবিধি প্রণয়ন প্রয়োজন। সংসদীয় কমিটি ও এর সদস্যদের বিশেষ ক্ষমতা নির্ধারণের জন্যও আলাদা আইন প্রয়োজন। সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের জন্য একটি আর্থিকভাবে স্বাধীন প্রশাসনিক সংস্থা গঠন করা হবে। সচিবালয় অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট, বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলা তদারকি করবে।
একটি স্বাধীন অপরাধ তদন্ত সংস্থা গঠনের জন্যও আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে। এতে রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক প্রভাব মুক্তভাবে ফৌজদারি অপরাধ তদন্ত করা যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত মালিকানা গোপন রাখা এবং দুর্নীতি রোধে একটি নতুন আইন প্রয়োজন। কোম্পানি, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের প্রকৃত মালিকদের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রকাশের কাঠামো এই আইনের আওতায় আসবে। বৈধ উৎস ছাড়া আয়ের বৈধতা দেওয়ার চর্চা বন্ধ করতে আরেকটি আইন হবে, যা নিরপেক্ষ নিরীক্ষা নিশ্চিত করবে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও রাষ্ট্রীয় বা আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে আইন করা হবে। এতে কেউ গোপন বা অঘোষিত সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এসব আইন সুশাসন নিশ্চিত করবে এবং সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। এগুলো মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজগুলো জনস্বার্থে হওয়া উচিত, ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে নয়।”
বিদ্যমান আইন সংশোধন:
- তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ পর্যালোচনা ও সংশোধন করা হবে। এতে নাগরিকরা সরকারি সেবা সম্পর্কিত তথ্য সহজে ও বাধাহীনভাবে পেতে পারবেন।
- নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোও এই আইনের আওতায় আনা হবে।
- নাগরিকদের সময়োপযোগী তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ১৯২৩ সালের গোপনীয়তা আইনও পর্যালোচনা ও সংশোধন করা হবে।
- রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা বাড়াতে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা হবে। দল ও প্রার্থীদের আয়ের উৎস, অর্থায়ন ও ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
- নির্বাচন কমিশন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়তায় প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া আর্থিক তথ্যের সত্যতা যাচাই করবে। অসঙ্গতি পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আয় ও সম্পদের বার্ষিক বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। এই বিবরণী কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।
- দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিকে দলীয় পদে নিয়োগ বা নির্বাচনে প্রার্থী করা যাবে না।
- দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর একটি ধারা বাতিল করা হবে। ফলে বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে কমিশনের বা সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।
- আইনের আরেকটি ধারা সংশোধন করে কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হবে।
- ২০০০ সালের আইনি সহায়তা আইন বাতিল করে আইনি সহায়তা ও মধ্যস্থতা সেবা অধ্যাদেশ জারি করা হবে।