হাইকোর্টের সাম্প্রতিক এক রায়ে ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ রিপোর্ট প্রমাণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর অনুপস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যে কোনো বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট তখনই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে, যখন রিপোর্ট প্রস্তুতকারী আদালতে হাজির হয়ে তার প্রমাণ দেবেন এবং সেই রিপোর্টে তার স্বাক্ষরের সত্যতা নিশ্চিত করবেন। এই প্রসঙ্গে আদালত উল্লেখ করেছে, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে রিপোর্ট গ্রহণের যে ধারণা রয়েছে, তা সাক্ষ্য আইনের মূল উদ্দেশ্য ও বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২০০৬ সালে হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা ধর্ষণের মামলার একটি বিশেষ দিক আলোচনায় উঠে আসে। ভিকটিমের অভিযোগ, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের ফলে তিনি সন্তানসম্ভবা হন। এরপর তদন্তের অংশ হিসেবে ডিএনএ টেস্ট করানো হয়। তবে ওই ডিএনএ রিপোর্ট আদালতে প্রমাণিত হয়নি, কারণ রিপোর্ট প্রস্তুতকারী আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেননি। যার ফলে সেই রিপোর্ট উচ্চ আদালতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় এবং প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়নি।
এই বিষয়ে বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের রায়ে বলেন, বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট তখনই প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে, যখন সেই বিশেষজ্ঞ আদালতে উপস্থিত হয়ে তার রিপোর্টের বিষয়বস্তু ও স্বাক্ষর প্রমাণ করবেন। রিপোর্ট প্রস্তুতকারী অনুপস্থিত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত আরও বলেন, কোনো বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট করোবরেট এভিডেন্স হিসেবে কেবলমাত্র উপযুক্ত ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা যেতে পারে।
২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন ভিকটিম। ট্রাইব্যুনাল মামলা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে আসামি কাছুম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৯ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনাল আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়, কিন্তু তিনি কোনো সাক্ষ্য প্রদান করেননি।
দীর্ঘ শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ২০১১ সালে আসামিকে খালাস দেন। খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে বাদী ব্যর্থ হন, কিন্তু পরে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ ক ধারায় আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে এবং শেষ পর্যন্ত খালাসের রায় বাতিল করে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
ডিএনএ রিপোর্টের প্রমাণের দায়ভার ছিল আসামির ওপর, কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হন। রিপোর্ট প্রস্তুতকারী আদালতে হাজির না হওয়ায় রিপোর্টটি আইনগত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। হাইকোর্ট স্পষ্ট করে জানায়, এ ধরনের মামলায় ভিকটিমের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে এবং তার সাক্ষ্য যদি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তবে সেটির ভিত্তিতেই দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এই মামলায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়নে মারাত্মক ভুল করেছেন, যার ফলে সঠিক রায় আসেনি। ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৩ ধারায় ভিকটিমের জন্য ভরণপোষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া সন্তানের ভরণপোষণ দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, যার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট ডিএনএ রিপোর্টের যথাযথ প্রমাণের গুরুত্ব আরও একবার তুলে ধরেছে এবং বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে রিপোর্ট গ্রহণের ধারণা বাতিল করেছে।