মনোয়ারুল হক-
উপমহাদেশের বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা, মোটা দাগে যা আজও আমরা অনুসরণ করে চলছি । সেই আলোকেই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। দেশ তিনটির বিচারিক আদালত সমূহ প্রায় অভিন্ন।
অতি-সাম্প্রতিককালে ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চ আদালত দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের ঘটনা সৃষ্টি করেছেন।
ভারতের বিরোধী দলীয় শীর্ষ রাজনীতিক রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে গুজরাটের একটি নিম্ন-আদালত তাকে মানহানির মামলায় দুই বছরের সাজার রায় দেন। মামলার বিষয়টি ছিল মোদি পদবী নিয়ে। ২০১৯ এর একটি জনসভার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মানহানির মামলাটি হয়। সেখানে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, মোদি নামের লোকজন কেন এত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে, ললিত মোদির নাম উল্লেখ করে একথা বলেন তিনি। ললিত মোদি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
মানহানির মামলা যিনি করেছিলেন তার যুক্তি ছিল, ভারতের এক বিশাল জনগোষ্ঠী মোদি পদবির অধিকারী। বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের মানহানি করেছেন রাহুল।
এ মামলায় নিম্ন-আদালত রাহুল গান্ধীকে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করেন, যা তার সংসদ পদ বাতিলে সহায়তা করে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে। আইনে এ ধরনের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তিও দুই বছরের।
২০২৩ সালের মার্চে রাহুলের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হওয়ার একদিন পরেই লোকসভার স্পিকার তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করেন। ভারতের সংবিধানের নিয়ম অনুসারে, কেউ ন্যূনতম দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হলে তার সাংসদপদ বাতিল হবে। নিম্ন আদালতের সেই রায়ের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর আপিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু, আপিলের রায়ের অপেক্ষায় না থেকেই লোকসভার স্পিকার তার সদস্যপদ বাতিল করেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অতীতের একটি রায়ে এমন একটি নির্দেশনা দেন যে: কোন ব্যক্তি দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে। এবং, কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সেই নির্দেশনায়ও অস্পষ্টতা ছিল । কোন ধরনের মামলার রায় কার্যকর হবে- তার উল্লেখ ছিল না। বিশেষ করে, এ ধরনের মানহানির মামলা আমলে নেওয়া হবে কিনা, বলা নেই।
ইতিপূর্বে রাজনীতিবিদদের বহু দুর্নীতির মামলা বছরের পর বছর আদালতে ঝুলে থাকতো এবং রাজনীতিবিদরা তাদের পদে বহাল থাকতেন।
রাহুল গান্ধীর মামলাটিতে প্রথমে জেলা আদালত, পরে গুজরাট হাইকোর্ট উভয় আদালতই মামলায় রাহুল গান্ধীর সাজা বহাল রাখেন । এরপর রাহুল গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সুপ্রিম কোর্ট প্রাথমিক শুনানিতেই মামলাটির রায় স্থগিত করে।
সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন-আদালতের রায়ের ব্যাপারে উল্লেখ করেন, কী কারণে রাহুল গান্ধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। এমনকি গুজরাট হাইকোর্টও বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেয়নি।
রায় পুরোপুরি বাতিল হবে কি-না, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। যদিও ইতিমধ্যে রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় উচ্চ আদালতের এই বিচারিক স্বাধীনতা জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করেছে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানের পক্ষে তাৎক্ষণিক আদেশ জারি করে তাকে মুক্ত করেছিলেন গত ৯ মের ঘটনার পর। ইমরান খান আবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। এবার তোষাখানার সম্পদ বিক্রি করার অভিযোগে তাকে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালত এক্ষেত্রে ইমরান খানের পক্ষে কোন সাক্ষীই গ্রহণ করেনি। সাক্ষী এবং শুনানি ছাড়াই এই সাজা দেওয়া হয়েছে ইমরানকে।
পাকিস্তানের সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে জুডিশিয়াল কমিশন গঠিত হয়েছে- সেটাই হচ্ছে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের মূল শক্তি। এই কমিশনের ফলে দল নিরপক্ষ ব্যক্তিবর্গের পক্ষে উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের দেশে অতীতে অষ্টম ও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে এমনই রায় দেন ঊচ্চ আদালত, কিন্তু আরও অতীতে পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে বিচার বিভাগ উদ্যোগ নিতে পারেনি দলীয় আনুগত্যের কারণে। পঞ্চম সংশোধনী বহুদিন আমাদের সংবিধানের অংশ ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর পঞ্চম সংশোধনীর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের অংশটুকু মুক্ত করা হয়। যদিও পরবর্তীতে সংশোধনীর একটি অংশ বাতিল করা হয়েছিল।
ভারতের উচ্চ আদালতের ১২ জন বিচারপতি গত কয়েক বছরে পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ একজন বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে তার পদত্যাগ ঘোষণা করে নজির সৃষ্টি করেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা করা হয়, হাইকোর্টসমূহের প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে অনুরূপ কোনো বিধান না থাকায়- বেশ কয়েকজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের কারণে। কয়েকজন আবার তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য হাইকোর্টে বদলির কারণে পদত্যাগ করেন।
সাধারণভাবে এসব বদলি সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের উচ্চ আদালতে সাম্প্রতিক কালে কোন পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের উচ্চ আদালতে জ্যেষ্ঠতা প্রাধান্য পায় না। ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে জেষ্ঠ্যতা নির্ধারিত। উভয় দেশের সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবে তাদের বিচারিক আদালত অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের দ্বারা প্রভাবিত- যা প্রযোজ্য রাহুল গান্ধী ও ইমরান খানের ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিচারিক আদালতের বিষয়টি প্রশ্নযোগ্য। ভারত ও পাকিস্তানের মতোই নানান ক্ষেত্রে বিচার ও বিচারকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
( দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডারড এর মতামত কলামে প্রকাশিত)