প্রিমিয়ার ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় ঘটে যাওয়া আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে। ব্যাংকটির শাখা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া রপ্তানি ও আমদানি দেখিয়ে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তদন্তে উঠে এসেছে যে, ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহিতা প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে ঋণ দিয়েছে এবং সেই ঋণের টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটি শুধু ব্যাংকিং আইনের লঙ্ঘন নয় বরং রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি গভীর আঘাত।
ঘটনার বিবরণ-
প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে রপ্তানির পরিমাণ কম দেখিয়ে তার বিপরীতে বেশিরভাগ কাঁচামাল স্থানীয় বাজার থেকে কেনা দেখানো হয়েছে। মূলত রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা হয়নি। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে, তাদের অধিকাংশের ঋণ পরিশোধের জন্য বিদেশী মুদ্রার প্রয়োজন ছিল।
তবে নিয়ম অনুযায়ী, রপ্তানির আয় থেকে ওই পরিমাণ ডলার আয় ও ঋণ পরিশোধ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ শাখায় সেই নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়।
বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শাখার কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল আমদানি দেখানোর পাশাপাশি, আমদানির জন্য ঋণ নেওয়ার পর সেই টাকা স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে তারপর তা ডলারে রূপান্তরিত করে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় পরিশোধ করেছে।
অর্থাৎ, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না গিয়ে তা পরবর্তীতে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে পাচার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
এমনকি শাখা থেকে ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩ হাজার ৮১ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের আমদানি শো-এ দেখানো হয়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি স্থানীয় বাজার থেকে কেনা কাঁচামাল। এমন অবস্থায়, রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৬৫ শতাংশ কম দেখানো হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ তৈরি করা হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই এখন অনাদায়ী।
শাখা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা-
তদন্তে উঠে এসেছে যে, শাখার ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা একযোগে এই বড় ধরনের জালিয়াতির সাথে জড়িত। তাঁরা নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ সীমা অতিক্রম করে প্রায় ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছেন এবং সেই ঋণ পরবর্তীতে নিয়ম অনুসারে পরিশোধও হয়নি। এর ফলে ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদিত ঋণ সীমার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমনকি, শাখার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যায়ে অসংগতি এবং অনিয়মের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি, যা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
তদন্তের অগ্রগতি এবং পদক্ষেপ-
এই ব্যাপারে বিএফআইইউ-এর পরিদর্শন প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দেওয়ার পর ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়। বিএফআইইউ-এর পরিদর্শনে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং তাদেরকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। তবে, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এখনও তদন্তের বাইরে রয়ে গেছেন। যেহেতু এসব অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাই বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদন্তের দাবি রাখে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকও একাধিকবার নারায়ণগঞ্জ শাখায় পরিদর্শন করলেও, কিছু বিষয়ের দিকে তারা নজর দেয়নি। পরবর্তী সময়ে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে বিএফআইইউ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ জমা দেয়। দুদক ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তদন্তের প্রসঙ্গ-
অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন তৈরি পোশাক খাতের টোটাল ফ্যাশন এবং অবন্তী কালার টেক্স, ভুয়া কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এর বিপরীতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রপ্তানি দেখানো হয়েছে খুব কম, অথচ আমদানি দেখানো হয়েছে বেশি। এর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাক টু ব্যাক এলসির প্রায় ৯৭ শতাংশই ছিল স্থানীয়ভাবে পরিচালিত। এ ধরনের বিষয় ব্যাংকিং নিয়ম এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি ছিল।
এছাড়া, আরও অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন ডোয়াসুল্যান্ড অ্যাপারেলস এবং ক্রনি অ্যাপারেলস, একই কৌশলে ঋণ নিয়েছে এবং তা পরিশোধ না করে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
আইনি ব্যবস্থা-
এই বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দুদক ইতোমধ্যে ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যারা এই অরাজকতায় জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদক এই তদন্তে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাচ্ছে এবং যারা এই কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ-
এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে, ব্যাংকটির মালিকানাধীন ব্যক্তিরা বা শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা। তবে, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুদক ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে, তাই শিগগিরই এই জালিয়াতির কুশীলবদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশাবাদী তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
এই ঘটনা প্রমাণ করেছে, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কতটা গভীরভাবে দুর্নীতি এবং অপব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হচ্ছে।