নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌর ভূমি অফিসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতির চিত্র নতুন করে জনসমক্ষে এসেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো ভূমি-সংক্রান্ত সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নামজারি থেকে শুরু করে চেক দাখিলা-সবক্ষেত্রেই নির্ধারিত নিয়মের বাইরে অর্থ দাবি করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভূমি অফিসের তিন নায়েবের একজন বড় এবং বাকি দুজন সহকারী। তাদের অধীনে কাজ করে চারজন প্রভাবশালী উমেদার-রাহেল, হারুন, লিটন এবং আলী। সেবা নিতে আসা জমি মালিকদের এই উমেদারদের কাছ থেকে নিতে হয় টিকিট, যার মূল্য ৮ হাজার থেকে শুরু করে জমির পরিমাণভেদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘুষের এই অঘোষিত মূল্য তালিকায় কখনো কখনো প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ভুক্তভোগীদের আর্তনাদ-
গত ৪ নভেম্বর তারাবো পৌর ভূমি অফিসে সরেজমিন উপস্থিত এই প্রতিবেদকের সামনে ২ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও জমাখারিজ না পাওয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা সুবর্ণা আক্তার। তার পৈতৃক সম্পত্তি খারিজ করার সময় নায়েব সরাসরি ২ লাখ টাকা দাবি করেন। বাধ্য হয়ে সেই টাকা দিলেও, প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সুবর্ণা বলেন, “আমার জমির মালিকানা নিয়ে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারে আমার ন্যায্য অধিকার আটকে রাখা হয়েছে।”
অন্যদিকে, তেতলাবো এলাকার বাসিন্দা মনিরুল কবির অভিযোগ করেন, তার ১০২ শতক জমি খারিজ করার জন্য প্রথমে ২ লাখ টাকা দাবি করেন নায়েব। পরে ফাইল ‘গায়েব’ করার অভিযোগ এনে তার সহকারী রাহেল মিয়া আরও ৫০ হাজার টাকা আদায় করেন। বিষয়টি ভিডিও ধারণ করায় মনিরুলকে উল্টো দালাল সাজিয়ে হয়রানি করা হয়।
বরপা এলাকার উদ্যোক্তা বকুল বেগম জানান, তার ১৪ শতক জমির সাড়ে ১২ শতক খারিজ করতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। বাকি জমির জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এমন চিত্র শুধু তারাবো নয়, রূপগঞ্জ উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার ভূমি অফিসে বিরাজমান। রূপগঞ্জ সদর ও কায়েতপাড়া ইউনিয়নে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ, যেখানে দালালদের প্রভাব মারাত্মক।
ঘুষের তত্ত্বাবধানে উমেদারদের ভূমিকা-
তারাবো ভূমি অফিসে উমেদারদের সরাসরি ঘুষ সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সহকারী নায়েব রোকেয়া আক্তার এবং বড় নায়েব আব্দুল কাদির সরাসরি বা উমেদারদের মাধ্যমে ঘুষ আদায় করেন। স্থানীয়দের মতে, অনলাইনে আবেদন করেও কোনো কাজ হয় না, যতক্ষণ না ঘুষের টাকা নায়েবদের হাতে পৌঁছায়।
কর্মকর্তাদের সাফাই-
সহকারী নায়েব রোকেয়া আক্তার তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি ডিসির নির্দেশে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। কোনো অনিয়মে আমি জড়িত নই।” অন্যদিকে, নায়েব আব্দুল কাদির দাবি করেন, “আমি সরাসরি কিছু নিইনি। অভিযোগকারী হয়তো দালালের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন।”
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি-
রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারিকুল আলম জানিয়েছেন, “ভূমি অফিসে দালাল প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে দুর্নীতির এমন শিকড়ে পৌঁছানো পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সংশয় রয়ে গেছে।
তারাবো পৌর ভূমি অফিসে চলমান দুর্নীতির এই চিত্র শুধু একটি দপ্তরের নয়; এটি আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। ঘুষের বলয়ে আটকে থাকা সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে আইন ও প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করছে। যে প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হওয়ার কথা, সেটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হলে সমাজের জন্য তা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তারাবোর ঘটনাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।