অন্তর্বর্তী সরকারের একটি পর্যালোচনা কমিটি বিগত সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প চিহ্নিত করেছে। পর্যালোচনা কমিটি জানিয়েছে, ২১টি চলমান আইসিটি প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বাদ দিলে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটি এসব প্রকল্পের ১৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ।
আইসিটি সচিব শীশ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার একেবারে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করেছি। আরও খরচ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ ধরনের খরচের যৌক্তিকতা আমাদের বোধের বাইরে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার দল হয়তো এ বিষয়ে উত্তর দিতে পারবেন।’
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন এসব প্রকল্পে অনিয়ম ও বিচ্যুতি শনাক্ত করতে একটি বর্তমানে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা চলছে। আইসিটি বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত পর্যালোচনা কমিটি আগের সরকারের সময় নেওয়া একাধিক অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়-স্ফীত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত প্রকল্প চিহ্নিত করেছে।
পর্যালোচনা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দুটি বিদেশি অর্থায়িত প্রকল্প—এস্টাবলিশড ডিজিটাল কানেক্টিভিটি (ইডিসি) এবং এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (এজ)—থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
পর্যালোচনা কমিটির প্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়-স্ফীত এবং বৈষম্যমূলক উপাদান বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। আরও অনেক সাশ্রয় করা যেত, যদি আগেই এত বেশি অর্থ ব্যয় করে ফেলা না হতো। ইতোমধ্যে চারটি সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক সংযোগ স্থাপনে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অবকাঠামো দুটি কোম্পানির সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় দেওয়া হয়, যেখানে সরকারের জন্য মোট আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ রাখা হয়।’
ইডিসি প্রকল্পের অধীনে গ্রামীণ এলাকায় (শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহ) এক লাখ ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানের জন্য বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকার বেশি বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মাহবুব রহমান আরো বলেন, ‘বাকি কাজগুলো ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা বাণিজ্যিকভিত্তিতে অনেক কম খরচে করতে পারত।’ তবে ইতোমধ্যে ক্রয়কৃত সরঞ্জামগুলো ৭০–৮০ শতাংশ বেশি দামে সংগ্রহ করা হয়েছিল। একইভাবে, ১০টি ডিজিটাল গ্রাম নির্মাণ বাতিল করলে ৫০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে। ‘বাকি হাজার হাজার গ্রাম কি দোষ করল?
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একীকরণ না করে নাগরিকদের বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক গ্রহণ এবং মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত ডেটা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন সিস্টেম নির্মাণের পরিকল্পনায় বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এজ প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা না পাওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। আমরা প্রশিক্ষণের সুযোগ কমানোর সুপারিশ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তি ল্যাব নির্মাণসহ এজ প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বাদ দিতে হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের সুবিধার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত কেরানীগঞ্জ হাই-টেক পার্কে একটি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ এটির কাজের অগ্রগতি অনেক বেশি হয়েছে। রংপুর, গোপালগঞ্জ ও নাটোরসহ বাকি পাঁচটি বাতিল হলে প্রায় ৯০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
পর্যালোচনা কমিটির পর্যবেক্ষণ:
পর্যালোচনা কমিটির মতে, অনেক প্রকল্পের অংশ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কিছু কিছু প্রকল্প আইসিটি বিভাগের দায়িত্বও ছিল না পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা প্রাসঙ্গিক সরকারি সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রকল্প গ্রহণে বিভাগের অতিউৎসাহ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
পলক অন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই তাদের ব্যবহারের জন্য এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭–১৮টি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন বলে জানান মাহবুবুর রহমান।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে তৈরি করুন এবং পরে অন্যদের এটি ব্যবহার করতে বাধ্য করুন ছিল তার নীতি। দুর্বল সমন্বয় এবং দ্রুততার সঙ্গে জিনিসপত্র ক্রয়ের কারণে খারাপ ফলাফল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।’
যেমন, ২০১৯ সালে প্রাক্তন আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের চালু করা একটি অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘একপে’ এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটরের লাইসেন্স পায়নি। ঠাকুরগাঁওয়ে আইটি পার্ক নির্মাণের জন্য অন্যান্য সরকারি অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও নতুন জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
কমিটির এক সদস্য জানান, পলকের নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগ আরও ডজনখানেক আইটি পার্ক, ইনকিউবেশন সেন্টার, কম্পিউটার ল্যাব, ট্রেনিং সেন্টার এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল। অথচ পূর্বের প্রকল্পগুলো ঠিকমতো চলছিলই না। এসব প্রশ্ন কেউই তোলেননি।
কমিটি উল্লেখ করেছে, প্রায় তিন ডজন হাই-টেক বা আইটি পার্ক প্রকল্পে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ, স্ফীত ভূমি উন্নয়ন খরচ এবং অ-শহুরে এলাকায় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। যে কোনো প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পলক শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করতেন, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে পরিবর্তন করে।
সম্ভাব্যতার অভাবে বান্দরবান, পটুয়াখালী ও ঠাকুরগাঁওয়ের নিকটবর্তী শহর থেকে অনেক দূরে তিনটি আইটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আ ক ম ফজলুল হক জানান, এখন পর্যন্ত তুলনামূলক কম অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং সিলেটের চারটি হাই-টেক পার্ক বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া, নির্মাণাধীন হাই-টেক পার্ক ভবনগুলোর উল্লম্ব বৃদ্ধি বন্ধ করেও তহবিল সাশ্রয় করা হবে।
কমিটি আরও জানায়, গেমিং ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি অপচয় হয়েছে, কারণ প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপগুলো ব্যবহার করা হয়নি অথবা প্রশিক্ষণার্থীরা যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। তারা এ ধরনের ব্যয় বন্ধের এবং পুনরাবৃত্তি না করার সুপারিশ করেছে।
‘আইসিটি বিভাগের সবগুলো শাখা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডিজিটাল ল্যাব তৈরির মতো একই প্রকল্পে কাজ করেছে, যেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, আইসিটি ডিপার্টমেন্ট এবং হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কোনো আলাদা কাজ নেই।’
নারীর ক্ষমতায়নের প্রকল্পে সুবিধাভোগী নির্বাচনেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পর্যালোচনায়। তাড়াহুড়ো করার কারণে পরিকল্পিত বিদেশি তহবিল নিশ্চিত করার আগেই জিনিসপত্র কিনে ফেলার ঘটনাকে কমিটি ‘প্রকল্প শৃঙ্খলার-বহির্ভূত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এদিকে, কিছু প্রকল্প প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কারণ এসব প্রকল্পের নির্ধারিত অনেক সুবিধাভোগী ইতোমধ্যে বিকল্প উপায়ে সুবিধা পেয়ে গেছেন, বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইসিটি নীতি উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তাইয়েব। তিনি আরও জানান, চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ চলছে।
আইসিটি প্রকল্পের ব্যয় কয়েক কোটি টাকা থেকে শুরু হয়ে গত এক দশকে কয়েকশ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তবে গত চার-পাঁচ বছরে এর আকার কয়েক হাজার কোটিতে পৌঁছায়। বিগত শাসনামলে ১৫–১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল। এসব প্রকল্পের কিছু কিছু দেখে কমিটির সদস্যরা অবাক হয়েছেন। ২৫টি অননুমোদিত পরিকল্পনার মধ্যে আটটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে কমিটি এবং অন্যগুলোর আকার অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।