বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংকে কেনাকাটা, সংস্কার ও প্রচারের নামে বড় অঙ্কের অর্থ তছরুপের ঘটনা তদন্তে উঠে এসেছে। পাশাপাশি ব্যাংকটির নিয়োগ, তহবিল ব্যবহার ও ঋণের ক্ষেত্রেও একাধিক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। বর্তমান সরকারের আমলে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম উদঘাটিত হয়েছে।
অনিয়মের ঘটনায় অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন ওয়ারেস উল মতিন, মোহাম্মদ তানভীর রহমান এবং এ কে এম নাজমুল হায়দার। তাদের মধ্যে ওয়ারেস উল মতিন ব্যাংকের সাতটি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন, মোহাম্মদ তানভীর রহমান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং এ কে এম নাজমুল হায়দার ছিলেন কোম্পানির সচিব। তদন্তে উঠে এসেছে, তারা মিলে ব্যাংকের ভেতরে অনিয়মের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন যা তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হতো।
ঘটনাকালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আলমগীর কবির। যিনি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে বড় অঙ্কের জরিমানার সম্মুখীন হয়েও চেয়ারম্যান পদে বহাল ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেও এখনো পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আসে এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ কাশেম আবারও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
২০২৩ সালে ব্যাংকের প্রচারের জন্য ২২ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়। এর মধ্যে মেট্রোরেল উদ্বোধন, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস উদ্যাপন ও বিজয় দিবস উপলক্ষে ইনবক্স কমিউনিকেশনের মাধ্যমে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা খরচ করা হয়। অথচ পরিচালনা পর্ষদের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এই অর্থ ব্যয় করা হয় এবং দরপত্র ছাড়াই ইনবক্স কমিউনিকেশনকে এই কাজ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় দেখা যায়, এই ২২ কোটি টাকার ব্যয়ের কোনো যথাযথ নথিপত্র নেই।
ব্যাংকে জমা দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী ইনবক্স কমিউনিকেশনের ঠিকানা বনানীর ৬২ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে হলেও বিল গ্রহণের জন্য নিকুঞ্জের একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দুটি ঠিকানাতেই গিয়ে তদন্তকারী দল প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিল জমা দিয়ে ইনবক্স কমিউনিকেশন ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করলেও এসব গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাংক কোনো বিজ্ঞাপন প্রচারের তথ্য পায়নি। মাছরাঙা টেলিভিশনের নামও বিজ্ঞাপন প্রচারের তালিকায় থাকলেও নির্বাহী পরিচালক অজয় কুমার কুণ্ডু এক চিঠিতে জানান, ২০২৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোনো বিজ্ঞাপন তারা প্রচার করেনি এবং এর জন্য কোনো বিলও পায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনো ধরনের ক্রয়নীতি না মেনে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই এই কাজ দেওয়া হয়েছে, যা চরম অনিয়ম। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালে ব্যাংকটি ছয় কোটি টাকার কম্বল কেনার কথা জানালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় দেখা গেছে, দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া তামান্না বেডিং স্টোর ও মেসার্স জারা ইন্টারন্যাশনালকে বাদ দিয়ে ঘুড়ি কমিউনিকেশনের মাধ্যমে কম্বল কেনা হয়। অথচ ঘুড়ি কমিউনিকেশন মূলত অফিস স্টেশনারি ও প্রিন্টিং আইটেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে আদৌ কোনো কম্বল কেনা হয়েছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, ছয় কোটি টাকার কম্বল কার কাছে বিতরণ করা হয়েছে, তার কোনো নথিপত্র ব্যাংকে নেই।
ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের দায়িত্বে থাকা ওয়ারেস উল মতিন ২০২২ সালে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ১৫ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। ২০২৪ সালে এই বিনিয়োগের মূল্য কমে দাঁড়ায় সাড়ে আট কোটি টাকায়। একইভাবে বিভিন্ন শাখার সাইনবোর্ড পরিবর্তন, ব্র্যান্ডিং ও সংস্কারের নামে সাড়ে তিন কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। তবে নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে এসব শাখায় কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে এই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে বলেও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
ওয়ারেস উল মতিন গত অক্টোবরে পদত্যাগ করেন। পরে ব্যাংকের কর্মকর্তারা লিখিতভাবে জানান, তারা কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি এবং তাদের স্বাক্ষর জাল করে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। ওয়ারেস উল মতিন অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন এবং ব্যাংক তাকে এখনো আনুষ্ঠানিক অব্যাহতি দেয়নি।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বে লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরকে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। একই ঘটনায় তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগমকে পাঁচ কোটি টাকা এবং জামাতা তুষার এল কে মিয়াকে আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে তিনজনকে মোট ১৯.৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়, যা তারা পরিশোধ করেছেন।
সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পরিচালক নির্দিষ্ট সময়ে ওই কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করতে পারেন না। কিন্তু আলমগীর কবির, তার স্ত্রী ও জামাতা এই আইন লঙ্ঘন করেছেন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বে লিজিংয়ের পরিচালক জুবায়ের কবির যিনি আলমগীর কবিরের ভাইয়ের ছেলে। তার প্রতিষ্ঠান ইরেবাস প্রপার্টিজের ঋণ ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়েছে। ফলে তিনি বে লিজিংয়ের পরিচালক পদে বহাল থাকার সুযোগ পেয়েছেন।
সাউথইস্ট ব্যাংকের এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।