বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর মডেলকে এভিয়েশনের ভাষায় ‘লং রেঞ্জ ওয়াইড বডি’ এয়ারক্রাফট বলা হয়। যার মানে হলো এটি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা একটি বৃহদাকার প্লেন। এই এয়ারক্রাফট একটানা সর্বোচ্চ ১৫-১৬ ঘণ্টা উড্ডয়ন করতে পারে বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি ২০ ঘণ্টাও উড়তে সক্ষম।
তবে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই শক্তিশালী এয়ারক্রাফটটি ব্যবহার করছে মাত্র ২০ মিনিট উড্ডয়নের জন্য এবং তা স্বল্প দূরত্বের রুট যেমন চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মধ্যে। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে প্লেনের আয়ুষ্কাল হ্রাস পাচ্ছে এবং পাশাপাশি লোকসানও বেড়ে যাচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর ব্র্যান্ডের চারটি বিমান রয়েছে। যেগুলোর নাম ‘পালকি’, ‘অরুণ আলো’, ‘আকাশ প্রদীপ’ এবং ‘রাঙাপ্রভাত’। এই ৪১৯ সিটবিশিষ্ট বৃহৎ প্লেনগুলো অতিরিক্ত উড্ডয়ন করার ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। একই পরিস্থিতি বিমানের ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের ক্ষেত্রেও।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সূত্র মতে, ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিভিন্ন রুটে পরিচালিত ৫০ শতাংশ ফ্লাইট চট্টগ্রামে অবতরণ করে এবং সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে আবার গন্তব্যে উড্ডয়ন করে। এছাড়া যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ম্যানচেস্টারের জন্য দুটি বিমান সিলেটে অবতরণ করে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বোয়িং ৭৭৭ এবং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার প্লেনগুলো বিশেষভাবে ঢাকা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডার মতো দূরবর্তী রুটে চলতে সক্ষম। তবে বিমানের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কেন এসব প্লেনগুলো স্বল্প দূরত্বের রুটে ব্যবহার করছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, বড় প্লেন সাধারণত দীর্ঘ দূরত্বের জন্য ডিজাইন করা হয়। স্বল্প দূরত্বে বারবার টেকঅফ এবং ল্যান্ডিং হলে প্লেনের ইঞ্জিন এবং ল্যান্ডিং গিয়ারের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যা দ্রুত ক্ষয়ে যেতে পারে। প্লেনের কাঠামোগত স্ট্রেস বৃদ্ধি পায় যার ফলে তার কর্মক্ষমতা এবং স্থায়িত্ব কমে যায়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা জানায়, একটি প্লেনের সি-চেক এবং ডি-চেক রক্ষণাবেক্ষণ খুব ব্যয়বহুল এবং সেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগে করাতে হলে খরচ বাড়ে। একটি সি-চেক সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকায় হয়, এবং ডি-চেকের খরচ ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো স্বল্প দূরত্বের রুটে বড় প্লেন পরিচালনা করলে সেগুলোর ল্যান্ডিং সাইকেল দ্রুত শেষ হয়ে যায় ফলে অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়ে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বোয়িং ৭৭৭ এবং ড্রিমলাইনার প্লেনের সিটপ্রতি খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা হতে পারে তবে সিলেট বা চট্টগ্রাম রুটে প্লেনের ভাড়া মাত্র ২০৩৪ টাকা (সরকারি ট্যাক্স ছাড়া)। অর্থাৎ বিমানের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে কারণ এই প্লেনগুলোর অপারেশনাল খরচ পূরণ হচ্ছে না।
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি একটি বোকামি সিদ্ধান্ত, যা বিমানের সাইকেল নষ্ট করছে এবং প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদী লোকসানে ফেলছে। তিনি আরো বলেন, বিমান যদি ছোট আকাশপথে বড় প্লেন ব্যবহার করতে চায় তবে তাদের উচিত এসব রুটে ছোট এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা এবং ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করা।
বিশ্বের অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত ছোট প্লেন ব্যবহার করে স্বল্প দূরত্বের রুটে। এমিরেটস এবং কাতার এয়ারওয়েজের মতো এয়ারলাইন্সগুলো বড় বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে (হাব) যাত্রীদের একত্রিত করে তারপর স্বল্প দূরত্বের রুটে ছোট প্লেন পাঠায়। এই মডেল অনুসরণ করে তারা লম্বা আকাশপথে যাত্রী পরিবহন করে এবং লোকসান কমায়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে ৫টি ড্যাশ-৮ মডেলের প্লেন রয়েছে, যা স্বল্প দূরত্বের রুটে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে বিমানের চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো রুটে বড় প্লেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, বিমান এয়ারলাইন্সের সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে এসব ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তবে বিমানের একটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে সিলেটের ব্যবসায়ীদের কাছে ইমেজ ধরে রাখার জন্য বিমানের লোকসান করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুট যেমন, ঢাকা থেকে দুবাই, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ওমান, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ফ্লাইট পরিচালনা করছে।