ফেনী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ড্রাফটম্যান শাহিন আলম। বয়স ৩২। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ২১,৪৭০ টাকা বেতন স্কেলে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু মাত্র ছয় বছরেই তিনি হয়ে উঠেছেন শতকোটি টাকার মালিক।
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ চমকে দেওয়ার মতো। এ সময়ে অন্তত ছয় দফায় ছয় জেলায় বদলি হয়েছেন। অভিযোগ, বেনামে ঠিকাদারি লাইসেন্স করে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
প্রান্তিক পরিবার থেকে উত্থান
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের শুভপুর ইউনিয়নের তেলিহাটি গ্রামের বাসিন্দা শাহিন আলম। তাঁর বাবা জয়নাল আবেদীন বাজারে বাদাম বিক্রি করতেন। ফসলি জমিও ছিল না। ডিপ্লোমা প্রকৌশল শেষ করে ২০১৮ সালে তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের সুপারিশে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাফটম্যান পদে চাকরি পান শাহিন।
চাকরির প্রথম পোস্টিং ছিল কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায়। দু-এক বছরের মাথায় ৬ শতক জমিতে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচে বানান একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে নানা অনিয়মের অভিযোগ। ২০১৯ সালের মার্চে তাঁকে বরুড়া থেকে লাকসামে বদলি করা হয়।
অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তৃতি
লাকসামে বদলির পর শাহিনের দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রীর আত্মীয় মোহব্বত আলীর সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘সিন্ডিকেট’। তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ ভাগিয়ে নেন।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৬২টি গভীর নলকূপ স্থাপনে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন শাহিন। আবার ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৮টি নলকূপ না বসিয়েই তুলে নেন ৪০ লাখ টাকা।
এর জেরে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁকে পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
নিজের নামে, আত্মীয়দের নামে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড়
প্রতিবেদকের হাতে থাকা দলিল অনুযায়ী, শাহিন শুভপুরে ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে একাধিক জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এরপর ২০২৩ সালে চান্দিনা উপজেলার থানগাঁও ও বেলাশর মৌজায় আরও জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
স্থানীয় কাদৈর বাজারে কেনা জমির মূল্য প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। জেলা শহরের বাগিচাগাঁওয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার খিলগাঁওয়েও রয়েছে কোটি টাকার ফ্ল্যাট।
বিলাসবহুল পরিবহন ও বিদেশে ব্যবসা
২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ইফাদ মোটরস থেকে ৫টি বিলাসবহুল স্লিপার কোচ কেনেন শাহিন, প্রতিটির মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। গাড়িগুলো বর্তমানে ঢাকার আরামবাগ থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচল করছে। মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয় সূত্র জানায়, গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন হয় ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর।
এ ছাড়া সোহেল রানার নামে আরো তিনটি কোচ, পণ্য পরিবহনে ১১টি ডাম্প ট্রাক, ১৫ কোটি টাকার ১১টি এক্সকাভেটর এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারে ৪৫ লাখ টাকার একটি টয়োটা প্রিমিও গাড়ি রয়েছে তাঁর।
বিভিন্ন ব্যাংকে শাহিনের নামে ও বেনামে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার এফডিআর। অভিযোগ রয়েছে, দুবাইয়েও রয়েছে তাঁর ব্যবসা।
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক উদাসীনতা
চৌদ্দগ্রাম জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জানান, ২০২১ সালে মুজিবুল হকের প্রভাবে ১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার ড্রেন নির্মাণ কাজ ভাগিয়ে নেন শাহিন। কাজের মান খারাপ হওয়ায় বাধা দেওয়া হলে তিনি বিল উত্তোলন করে কাজ না করেই পালিয়ে যান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, লাকসামে নানা অনিয়মের পেছনে পলাতক নেতা মোহব্বত আলীর ভূমিকা ছিল। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ব্যর্থ হয় প্রতিবেদনকারী। জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
একাধিক অভিযোগ, তদন্তের মুখে শাহিন
২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে শাহিনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন আরমান মিয়া নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগে তুলে ধরা হয় তাঁর সব অবৈধ সম্পদের বিবরণ।
পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে শাহিনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে।
ফেনী জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হক বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ফেনীতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে, তদন্ত চলমান রয়েছে।
ঘুষ প্রস্তাব ও সাংবাদিককে হুমকি
গত রোববার বিকেলে শাহিন আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রতিবেদকের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তা প্রত্যাখ্যান করলে উত্তেজিত হয়ে বলেন, “আপনার মন যা চায় তা আমার বিরুদ্ধে লিখে দেন।” সুত্র: আজকের পত্রিকা