বাংলাদেশের বীমা খাতে আস্থা আজ প্রশ্নের মুখে। হাজার হাজার কোটি টাকার বিমা দাবি বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে, আর ঠিক এই কারণেই ১৫টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কার্যক্রম নিয়ে শুরু হয়েছে বিশেষ নিরীক্ষা।
এই উদ্যোগ নিয়েছে দেশের বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা—বীমা ন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। প্রতিষ্ঠানটি সন্দেহ করছে, বহু গ্রাহকের দাবির নিষ্পত্তি না হওয়ার পেছনে হয়তো লুকিয়ে আছে গুরুতর অনিয়ম, যা এখন খতিয়ে দেখা হবে নিখুঁতভাবে।
আইডিআরএর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়েছে একটি অভ্যন্তরীণ গ্রেডিং সিস্টেমের ভিত্তিতে, যা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়। সে তালিকায় এই কোম্পানিগুলো উঠে আসে সবচেয়ে দুর্বল পারফর্মার হিসেবে। এর পরপরই নেওয়া হয় বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত।
তবে বিশেষ নিরীক্ষা মানে এই নয় যে এটা কোনো রুটিন চেকআপ। এটা অনেক বেশি লক্ষ্যভিত্তিক ও সংবেদনশীল। যেখানে যেকোনো নির্দিষ্ট সমস্যা—যেমন অর্থ কেলেঙ্কারি, অব্যবস্থাপনা বা দুর্নীতি—বিস্তৃতভাবে অনুসন্ধান করা হয়।
আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে এই ১৫টি কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের বিমা দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। কিন্তু তাদের পরিশোধ করা টাকার অঙ্ক হতাশাজনকভাবে মাত্র ৬৩৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বাকি কয়েক হাজার কোটি টাকা এখনো ঝুলে আছে, যেটি গ্রাহকদের জন্য শুধু আর্থিক নয়, মানসিক চাপেরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত রবিবার আইডিআরএ এই নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে দেশের ১৫টি ভিন্ন অডিট ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিটি অডিট ফার্মকে নির্দিষ্ট কোম্পানির নিরীক্ষা শেষ করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
নিরীক্ষার সময় বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হবে, কোম্পানিগুলো বীমা আইন ২০১০ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে কি না, আর যদি কোনো ব্যত্যয় বা অব্যবস্থাপনা থাকে, তাহলে তা চিহ্নিত করা হবে রিপোর্টে।
কে কে পড়েছে নজরদারির তালিকায়?
যেসব কোম্পানি এবার এই নজরদারির আওতায় এসেছে, তাদের তালিকায় রয়েছে:
-
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স
-
হোমল্যান্ড লাইফ
-
পদ্মা ইসলামী লাইফ
-
প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ
-
বেস্ট লাইফ
-
প্রাইম ইসলামী লাইফ
-
প্রোগ্রেসিভ লাইফ
-
যমুনা লাইফ
-
ডায়মন্ড লাইফ
-
স্বদেশ লাইফ
-
সানফ্লাওয়ার লাইফ
-
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ
-
গোল্ডেন লাইফ
-
বায়রা লাইফ
-
এনআরবি ইসলামিক লাইফ
ডেইলি স্টার জানিয়েছে, এসব কোম্পানির মধ্যে পাঁচটির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে চারটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। একটি কোম্পানির এক কর্মকর্তা শুধু জানান যে, তারা এখনো আইডিআরএ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পাননি।
অনিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় কমাতে ইতোমধ্যেই গাড়ি বিক্রি ও কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। অথচ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের গ্রাহক দাবি ছিল ২,৯৪৬ কোটি টাকা, কিন্তু পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১৯৪ কোটি—মানে মোট দাবির কেবল ৬ শতাংশ!
আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এই নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু পরিসংখ্যান দেখা নয়, বরং খুঁজে বের করা যে, কারা কারা অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়, লাইফ ফান্ডের ঘাটতি ও দাবির নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা—সব কিছুই এবার খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহ-সভাপতি ও ডেল্টা লাইফের স্পনসর ডিরেক্টর আদিবা রহমান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো না গেলে গ্রাহকদের আস্থা কখনোই ফিরবে না। আর আস্থা না ফিরলে এই খাত টেকসইভাবে এগিয়ে যাবে না।”
বর্তমানে দেশে ৮২টি বীমা কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা (লাইফ ইন্স্যুরেন্স) কোম্পানি এবং ৪৬টি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।গ্রাহকদের সঞ্চয়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এই খাত যদি দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে বিশ্বাস হারায়, তাহলে ক্ষতিটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সমাজিকও। বিশেষ নিরীক্ষার এই উদ্যোগ সফল হলে হয়তো আশার আলো দেখা যেতে পারে। নাহলে অনিশ্চয়তার এই অন্ধকারেই হয়তো হারিয়ে যাবে আরও হাজারো স্বপ্ন।