২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর চালু হওয়া কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করার আশা ছিল। টানেলের মূলে ছিল একটি দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার গড়ে তোলা যা চট্টগ্রামের সড়ক অবকাঠামোর উপর চাপ কমাবে এবং আঞ্চলিক শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে।
কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও কর্ণফুলী টানেল তার প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। টানেলের প্রতিদিনের যান চলাচল এবং টোল আদায়ের হিসাব দেখায়, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ যানবাহন টানেল ব্যবহার করছে। অথচ লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন ২০ হাজারেরও বেশি যানবাহন টানেল পার হবে। কিন্তু ২০২৪ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩৯৩৪টি যানবাহন টানেলটি ব্যবহার করেছে, যা প্রকল্পের প্রাথমিক হিসাবের তুলনায় অত্যন্ত কম। টোল আদায়ের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কম, যেখানে প্রতিদিনের টোল আদায় ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকা হলেও টানেলটির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ফলে প্রতিদিনই ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
এই ব্যর্থতার পেছনে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আনোয়ারা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্প প্রকল্পগুলো এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। চায়না ইকোনোমিক জোনসহ বেশ কিছু বড় শিল্প প্রকল্পের উপর নির্ভর করে টানেলের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এখনও এসব প্রকল্পের পূর্ণ কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় টানেলের প্রয়োজনীয় যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, টানেলটি ছিল অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, ঠিকমতো বিবেচনা করা হয়নি। দক্ষিণ প্রান্তে কারখানাগুলোর উন্নয়ন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটির সাফল্য নিয়ে আশাবাদী হওয়া যৌক্তিক নয় বলে তিনি মনে করেন।
চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণও এই টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৮ হাজার যানবাহন টানেলটি ব্যবহার করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে ৫ হাজার যানবাহনও টানেল পারাপার করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
টানেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ অবশ্য এই ব্যবস্থাকে আরও কিছু সময় দেওয়ার পক্ষে। তাঁর মতে, ইন্টারনাল রোড কানেক্টিভিটি এবং শিল্পকারখানা বিকাশের জন্য যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে যেমন সময় লেগেছিল, তেমনি কর্ণফুলী টানেলেরও উন্নয়ন সময়সাপেক্ষ হবে। তবে তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, যদি নির্ধারিত শিল্পায়ন দ্রুতগতিতে না হয়, তাহলে এই টানেল তার পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটির দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করছে পরিকল্পিত শিল্প প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, আনোয়ারা প্রান্তের শিল্পায়ন এখনও অগ্রগতির মুখ দেখেনি। আনোয়ারার পরিকল্পিত শিল্পকারখানাগুলো এবং চট্টগ্রামের বে-টার্মিনাল ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এখনও পুরোপুরি চালু না হওয়ায়, টানেলের প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি এখন অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, টানেলটি নির্মাণের পরিবর্তে সেই অর্থ দিয়ে অন্তত ১০টি সেতু নির্মাণ করা যেত। তাঁর মতে, মেগা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে অর্থের অপচয় করা হয়েছে এবং এখন যে প্রতিদিনকার লোকসান হচ্ছে, তার জন্য কে দায় নেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, “এই টানেল এখন এক ধরনের অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
টানেল দিয়ে পারাপারের জন্য যানবাহনগুলোর জন্য যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক তাঁর এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, কর্ণফুলী টানেলের টোলহার অত্যন্ত উচ্চ এবং এটি শাহ আমানত সেতুর তুলনায় ২.৫ থেকে ৬ গুণ বেশি। এর ফলে অনেক চালক টানেল ব্যবহার করতে উৎসাহী হচ্ছেন না, যা টানেলের অর্থনৈতিক সাফল্যকে ব্যাহত করতে পারে।
প্রকল্পটি বর্তমানে চট্টগ্রামের পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটি স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে এর মূল উদ্দেশ্য, যেমন যান চলাচল এবং বাণিজ্যিক সুবিধা, তা এখনও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
সার্বিকভাবে, কর্ণফুলী টানেল একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হিসেবে শুরু হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর সাফল্য এখনও অনিশ্চিত।