বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। এই ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক গুলোকেও পরিচালিত করে। এর প্রধান কাজ হল- মুদ্রানীতি পরিচালনা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধান, সরকারি অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন, দেশের মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকে। ব্যাংকিং খাতের ওপর একটি দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। যখন কোনো দেশের ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করার মত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর সুপরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল ব্যাংক রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করা যাবে না। এ নীতি ধরে রাখতে হবে, সরে আসা যাবেনা। অর্থনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তারল্য সংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থের যোগান দেয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে এর তারল্য যোগান দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে ভিত্তিগত দুর্বলতার ফলে কিছু ব্যাংককে একত্রীকরণ করা হয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে একত্রিত করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকের সাথে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একত্রিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাথে। এগুলোর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সাথে একত্রিত হচ্ছে বেসিক ব্যাংক। আবার বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সাথে ব্যাপক লুটপাত ও দুর্নীতি শিকার পদ্মা ব্যাংক বা সাবেক ফার্মারস ব্যাংক কেউ একত্রিত করা হয়েছে যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া সব শেষ আরও যে ব্যাংকগুলো একত্রিকরণের আলোচনায় ছিল সেগুলো হল বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, এবি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। এভাবে একীভূতকরণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের সংখ্যা ৪৪টি করা হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সে সময় ধারণা করেছিলেন। এছাড়া আরো কিছু ব্যাংক এ পরিকল্পনাধীন রয়েছে, যাতে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
দুর্বল ব্যাংকগুলো কয়েকটি সংকেত দ্বারা চিহ্নিত করা হয়- অর্থনৈতিক সূচক ,উচ্চ ঋণ ব্যবস্থাপনার সমস্যা বা অনিয়মিত ঋণ পরিশোধ, ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গীকার বা বিধি নিষেধ, শেয়ার মূল্য কমে যাওয়া বা বাজারে পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংককে একীভূত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে ভাল। তবে এটি আসলেই কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নির্ভর করবে একীভূত ব্যাংকগুলো কতটা ভালভাবে পরিচালিত হতে পারে তার উপর। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, দেশের ৫০টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ১০টি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এগুলো টিকে থাকতে হলে অন্যান্য ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
দেশের ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে যেকোনো পরিকল্পনা খুব সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত। কেননা ব্যাংকিং খাত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাংকিং সেবা জনগণের বৃহত্তর অংশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নীত করে। ব্যাংকগুলো মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, যা মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। তাই দুর্বল ব্যাংক গুলোর সাথে সবল ব্যাংকের একত্রীকরণ সর্তকতার সাথে করা উচিত যাতে ফলাফল অনাকাঙ্ক্ষিত না হয়।
দুর্বল ব্যাংকের সমস্যা: দুর্বল ব্যাংকগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক চাপ এবং পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পারে না। দুর্বল ব্যাংকগুলোর অপর্যাপ্ত মূলধন না থাকায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারায় ফলে তাদের সংকটে পড়তে হয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রায়ই নন- পারফর্মিং অ্যাসেটস (NPA) বেশি থাকে, যা তাদের আর্থিক সংকটে পড়ার সম্ভাবনা বেশি তৈরি করে। এই ব্যাংকগুলোর অকার্যকর ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ একটি বড় সমস্যা। যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। ফলশ্রুতিতে সঠিক এবং সময় মত আর্থিক প্রতিবেদন না থাকায় ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাস যোগ্যতা কমতে থাকে।
এ সমস্যা গুলি মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে সুপরিকল্পনা: নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্বল ব্যাংকের একত্রীকরণ ও তার প্রভাব- ব্যাংক হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি মূল অংশ। এটি আমানতকারীর জমানো টাকা নিরাপদ রাখে এবং ঋণ প্রদান করে আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করে। তবে কখনো কখনো ব্যাংক গুলির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে, যার ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক রক্ষা করতে গিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তা হল-
দুর্বল ব্যাংকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি বা অর্থায়ন প্রদান করতে হয়। যা জাতীয় বাজেটের ভারসাম্যহীনতা এবং বৃহৎ মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ব্যাংক রক্ষার জন্য খরচ করা অর্থ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় হতে পারত। যেমন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা বা অবকাঠামো উন্নয়নে।
দুর্বল ব্যাংকে রক্ষা করতে গিয়ে অন্য ব্যাংকগুলোর আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের মাঝে অস্থিরতা দেখা দেয়। একটি ব্যাংকে বাঁচাতে গিয়ে বৃহৎ অংকের অর্থ ব্যয় করা হয়, যার ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে। এতে বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা সম্মুখীন হন এবং বাজারে অস্থিরতা বাড়ে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার ফলে অর্থনীতির উপর চাপ পড়ছে।
দুর্বল ব্যাংক রক্ষা করার সময় অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে কমিয়ে আনার জন্য কিছু কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে-
প্রাক নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা: ব্যাংক গুলির নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন নিয়মিত ভাবে করা, এবং সমস্যা হলে তার দ্রুত সমাধান করা।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ব্যাংক গুলির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যাতে কোন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি তৈরি হলে তা দ্রুত সমাধান করা যায়।
তহবিল সংরক্ষণ: ব্যাংক সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকারি তহবিল সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যা সংকটকালে ব্যবহৃত করা যাবে।
স্বচ্ছতা ও গণনা: ব্যাংক রক্ষা করতে গিয়ে অর্থের ব্যবহার বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জনগণ ও বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থার বিষয়ে বিশেষ সচেতন হয়।
ব্যাংক পূর্ণ গঠন: দুর্বল ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পূর্ণ গঠন করা। যেমন -নতুন ব্যবস্থাপনা আনা বা ঋণের পরিমাণ বাড়ানো।
জন প্রত্যাশা ও বিনিয়োগকারীর বিশ্বাস: দুর্বল ব্যাংক রক্ষা করতে হলে বিনিয়োগকারীর বিশ্বাস যোগ্যতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-ব্যাংক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা, পুঁজি বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জনপ্রশাসনিক সহায়তা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
ব্যাংক সেক্টর একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল ব্যাংকে রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হওয়া একটি বাস্তব সমস্যা। এক্ষেত্রে প্রাক-নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে উক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করে ব্যাংকিং সেক্টরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একত্রিতকরণকৃত ব্যাংকগুলো যাতে আবার দেশের অর্থনীতির কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।