বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO- World Trade Organisation) একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত। আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সূচনা শুরুর কাহিনী বললেই চলে আসে গ্যাটের কথা। গ্যাট হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পূর্বসূরি (GATT- General Agreement on Tariffs and Trade)।
এটি মূলত একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, যা ১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনা এবং বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গ্যাট দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ব বাণিজ্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এটি ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। বর্তমানে জটিল ও পরিবর্তনশীল বাণিজ্যিক পরিবেশে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এর কাজের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শাসন ব্যবস্থা অনেক উচ্চতর প্রতিনিধি দল নিয়ে গঠিত হয়েছে।
আজকের বিশ্বে বাণিজ্য কেবল পণ্য ও সেবা আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রযুক্তি, তথ্য এবং সংস্কৃতির আদান- প্রদানের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে। এই পরিবর্তনশীল পরিবেশে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাজ হলো সবার জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্যিক বাধা কমানো, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ন্যায় সংগত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, বানিজ্যের প্রসার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করা। এর কাজ বিশ্বব্যাপী সংঘটিত হচ্ছে।
এর কার্যাবলীর ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয় যে, বর্তমানে এ সংস্থার মুখোমুখি অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। করোনা মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানির সংকটের মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ, মহামারীর ফলে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। যা বিশ্ব বাণিজ্যে বিশাল পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। গ্যাট এই পরিস্থিতিতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যাতে করে সাপ্লাই চেইন পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিশীলতা অর্জন করা যায়।
এ সংস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাণিজ্যিক বিতর্ক সমাধান। সদস্য দেশগুলো যখন একে অপরের বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন গ্যাট এ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। এই প্রক্রিয়া সদস্য দেশগুলোকে তাদের অভিযোগের জন্য একটি ফোরাম দেয়। যেখানে তারা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক বিতর্ক ছিল। যা এর মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হয়।
গ্যাট এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত মেনে চলতে হয়, যা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। গ্যাট দেশগুলোকে একটি সুষ্ঠু এবং সমান সুযোগ দিতে কাজ করে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ায়, যাতে তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল বাণিজ্যের উত্থান এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এ সংস্থাটির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এতোদিন ধরে চলে আসা কাঠামো ও নীতি পদ্ধতিকে পরিবর্তন করেছে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এই ডিজিটাল বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে নতুন নীতিমালা তৈরি করছে, যাতে করে সদস্য দেশগুলো একটি সাধারণ ভিত্তিতে কাজ করতে পারে।
পরিবেশগত সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনও এর কার্যাবলীর চ্যালেঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাণিজ্য কার্যক্রমের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গ্যাট এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি নিশ্চিত করবে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পরিবেশের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা হয়।
অবশেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়- গ্যাট এর কাজের গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নয়ন, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করণ এবং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে এর ভূমিকা অপরিসীম। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহযোগিতা করে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা স্থাপন করে গ্যাট বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করছে। এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের মাধ্যমে আশা করা যায় যে, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং টেকসই পরিবেশ গড়ে তুলবে। যা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয় বরং বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে করে গ্যাট এর মাধ্যমে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমেই বিশ্বের দেশগুলোর সহায়তার জন্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা গড়ে তোলার সার্থকতা পাওয়া যাবে।