বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির তালিকায় ছানামুখী মিষ্টি একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি মিষ্টি নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং স্বাদবোধের একটি প্রতীক।সম্প্রতি ছানামুখী মিষ্টির জন্য বাংলাদেশ ভৌগোলিক স্বীকৃতি বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (GI) স্বীকৃতি অর্জন করেছে, যা এর জনপ্রিয়তা এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে এই অতুলনীয় স্বাদের পরিচয় তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে।
ছানামুখী মিষ্টির ইতিহাস প্রাচীন। এটি সাধারণত দুধের ছানা থেকে তৈরি হয় এবং পরে বিভিন্ন স্বাদের সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। মিষ্টিটির বিশেষত্ব হলো এর নরম ও কোমল প্রকৃতি, যা মুখে রাখার সাথে সাথে গলে যায়।এ মিষ্টি মুখে দেওয়ার সাথে সাথে মিষ্টি ভাবের সাথে কিছুটা টক স্বাদও পাওয়া যায় ,যা এর স্বাদকে অন্যান্য মিষ্টি চেয়ে আলাদা করে তুলে ।মিষ্টিটি সাধারণত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন বিয়ে, ঈদের দিন, পুজো, ও অন্য কোনো উৎসবে পরিবেশন করা হয়।
ছানামুখী মিষ্টির প্রস্তুত প্রক্রিয়া খুবই সূক্ষ্ম এবং কৌশলী। প্রথমে দুধকে গরম করে এতে লেবুর রস বা অন্য কোনো অ্যাসিড যুক্ত করা হয়, যার ফলে দুধের কোজার তৈরি হয়। এই কোজারকে কিছু সময় পর ফেলে দেওয়া হয় এবং পরে এটিকে মিষ্টির আকার দেওয়া হয়। মিষ্টির স্বাদ বাড়ানোর জন্য এতে চিনির সিরাপ বা পেস্ট দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে প্রয়োজনীয় যত্ন এবং দক্ষতা মিষ্টির গুণগত মান বাড়ায় ।সাত থেকে আট লিটার দুধের সঙ্গে এক কেজি চিনি দিয়ে তৈরি হয় এক কেজি ছানামুখী। প্রতি কেজি ছানামুখী বিক্রি করা হয় ৭০০ টাকায়। প্রায় দেড় শ বছর আগে ‘ছানামুখী’ নামের এই মিষ্টির উৎপত্তি ।
ছানামুখী মিষ্টির রয়েছে পুরোনো ইতিহাস। ভারতের কাশিধামের এক কারিগর মহাদেব পাঁড়ে এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন। তার ভাই দুর্গা প্রসাদের সঙ্গে কলকাতায় এসে তিনি একটি মিষ্টির দোকানে কাজ নেন। দুর্গা প্রসাদের মৃত্যুর পর, মহাদেব পাঁড়ে সেই দোকান ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন এবং নানা জায়গায় ভ্রমণ করতে করতে একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছান। সেখানে পৌর এলাকার মেড্ডার শিবরাম মোদকের দোকানে কাজ শুরু করেন। মহাদেব পাঁড়ে শিবরামের দোকানে ছানামুখী তৈরি করে অল্প সময়ের মধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দোকানিরাও এই মিষ্টি তৈরি করতে শুরু করেন। লোক মুখে প্রচলিত আছে, ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে কোনো একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন বড় লার্ট লর্ড ক্যানিং এবং তাঁর স্ত্রী লেডি ক্যানিং ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন এবং সেখানে তৈরি দুই ধরনের মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। তাই লেডি ক্যানিংয়ের নামানুসারে একটির নাম রাখা হয় ‘লেডি ক্যানিং’, আরেকটি ‘ছানামুখী’। মূলত তাদের আপ্যায়নের জন্যই এই দুটি মিষ্টি বানানো হয়েছিলো। দুধ, ছানা আর চিনিতে তৈরি ছানামুখীর সুনাম তখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বেড়াতে এসে ছানামুখী নিয়ে যাননি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তথ্য বাতায়নে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে উল্লেখ আছে ছানামুখীর নাম।সেখানে বলা আছে, ছানামুখীর উৎপত্তি ব্রিটিশ রাজত্বকালে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ছানামুখীর জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি দেশের কৃষিখাত এবং অর্থনীতিতে একটি বিশেষ সাফল্য।এই স্বীকৃতি ছানামুখীকে আন্তর্জাতিক বাজারে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছে এবং দেশীয় উৎপাদকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই জিভে জল আনা এই মিষ্টান্নের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। যদি একটি দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং সেখানকার মানুষের সংস্কৃতি কোনো বিশেষ পণ্য তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে, তবে সেই পণ্যকে ঐ অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই স্বীকৃতি পণ্যের গৌরবকে বাড়ায় এবং ঐ এলাকার পরিচয়কে বিশ্বজুড়ে তুলে ধরে। কোনো একটি পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী এ মিষ্টি এর অতুলনীয় স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও সম্প্রতি এর জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তির ফলে বলা যায় এতোদিনে এর স্বাদ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের সার্থকতা পূরণ হয়েছে।ছানামুখী বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে পরিচিত। এর উৎপাদনের ধরন, মাটি ও আবহাওয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর পুষ্টিগুণ ও স্বাদকে বিশেষ করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর আশেপাশের অঞ্চলে আপ্যায়ন ও খাদ্যের দিক দিয়ে এই টক মিষ্টি স্বাদের খাদ্যটি একটি অপরিহার্য অংশ।
জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তি এখন থেকে এই মিষ্টির জন্য এক ধরনের ব্র্যান্ডিং হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে ছানামুখি স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। বলা যায় বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে এর মূল্যও বৃদ্ধি পাবে।যেহেতু জিআই স্বীকৃতি একটি পণ্যের গুণমান এবং স্বকীয়তা সুরক্ষিত করে, তাই এর মাধ্যমে এর ময়রা বা উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন।যা স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করে দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়।ছানামুখীর জিআই স্বীকৃতি এ মিষ্টির গুরুত্ব ও স্বাদকে দেশের সব অঞ্চলের মানুষের কাছে যেমন নতুন করে তুলে ধরবে তেমনি দেশের মানুষকে দেশের প্রতিটি পণ্যের গুরুত্ব নতুন করে শিখাবে। এর ফলে কর্তৃপক্ষ দেশের অন্যান্য ভৌগোলিক সম্পদের জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কাজ করতে সচেতন হবে বলেও আশা করা যায়। এভাবেই টক মিষ্টি স্বাদের অতুলনীয় এ ছানামুখী তার স্বাদ ও অনন্যতা দিয়ে দেশের মানুষের মন জয়ের পাশাপাশি জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তির মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে সার্থকতা অর্জন করেছে।