প্রথমেই আমরা জানতে চাই রাজস্ব নীতি কি?
রাজস্ব নীতি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন উপাদানের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল। এটি সরকারের আয়-ব্যয় এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে সমৃদ্ধ করে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুষ্ঠু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার একটি কার্যকর রাজস্ব নীতি তৈরি করে।
এই নীতির মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য হলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, উন্নয়নশীল খাতগুলোকে উৎসাহিত করা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। রাজস্ব নীতির সুপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন-সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সফলতা ও প্রবৃদ্ধির চিত্র তৈরি করে, যা জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে রাজস্ব আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের উন্নয়ন এবং মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি অপরিহার্য। বাংলাদেশে এই রাজস্ব আয় বৃদ্ধি একটি চ্যালেঞ্জ, যেখানে সরকারের বাজেট ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। এজন্য রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রথমেই বলতে হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে কোভিড- ১৯ মহামারি এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করতে হচ্ছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল করার জন্য সরকারকে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হলে কর নীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সরকারের রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন আনতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে কর ব্যবস্থাকে সহজতর করার দিকে। দেশে বর্তমানে করদাতার সংখ্যা সীমিত, যা দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার নতুন কৌশল গ্রহণ করছে, যেমন স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কর সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান করা। এতে করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য করের বোঝা কমবে এবং নতুন করদাতাদের অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হবে।
সরকারের নতুন পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কর সংগ্রহ প্রক্রিয়া সহজ করা। দেশে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে রাজস্ব নীতির কার্যক্রমকে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিজিটাল কর সিস্টেম চালু হলে, জনগণ সহজে অনলাইনে কর পরিশোধ করতে পারবেন। যা তাদের জন্য সহজ হবে এবং সরকারের জন্য আয় সংগ্রহে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে, সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির একটি প্রধান পথ হলো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারের নীতিতে পরিবর্তন এনে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা হলে, দেশের উন্নয়ন দ্রুত ঘটবে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সরকারের সহজ শর্ত, নিরাপত্তা এবং প্রণোদনা দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকারের রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কর ছাড়, ঋণের সহজ শর্ত এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে করে নতুন নতুন শিল্প সৃষ্টি হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। যা পরোক্ষভাবে সরকারের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জন সচেতনতা বৃদ্ধি। নাগরিকদের মধ্যে কর প্রদানের প্রয়োজনীয়তা এবং সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সরকারের প্রচারণা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং জনগণের কাছে কর সম্পর্কে সঠিক তথ্য পৌঁছাতে হবে, যাতে তারা কর পরিশোধে আগ্রহী হন।
অন্যদিকে, দেশের রাজস্ব নীতিতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য দেশের সফল রাজস্ব নীতি বিশ্লেষণ করে, আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে কীভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে, কর নীতি ও শুল্ক ব্যবস্থায় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে নজর দিতে হবে, যাতে বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে পারদর্শী হতে পারে।
সবশেষে, রাজস্ব নীতির পরিবর্তন করতে হলে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকর পরিকল্পনা অপরিহার্য। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজস্ব নীতির এই পরিবর্তন দেশের উন্নয়নের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পরিশেষে বলা যায়, রাজস্ব নীতির পরিবর্তন সরকারের আয় বৃদ্ধির নতুন পথ হিসেবে কাজ করবে। সঠিক পদক্ষেপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি উন্নত অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারবে। আমরা আশা করি, সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে এবং দেশের জনগণ এই পরিবর্তনের সুফল পাবেন।