বাংলাদেশে এ বছর চায়ের উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাসের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অতিরিক্ত বৃষ্টি, খরা এবং একাধিক বন্যার প্রভাবে চা বাগানের পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন কমে গিয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বা পাঁচ লাখ কেজি চায়ের ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড ও চা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, এই বছর চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন কেজি। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বিশেষত, অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং খরার প্রভাব চা গাছের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, যা উৎপাদনে বড় ধরণের প্রভাব ফেলেছে।
চা উৎপাদনকারীরা জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তখন তারা ভেবেছিলেন এটি চায়ের কুঁড়ির বিকাশে সহায়ক হবে। কিন্তু পরবর্তীতে অবিরাম ভারী বৃষ্টি, অতিরিক্ত স্যাঁতসেঁতা পরিবেশ এবং সূর্যের আলো কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এতে মাটির ক্ষয় হয়ে সার নষ্ট হয়েছে এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। যার ফলে চায়ের কুঁড়ি বিকাশে ব্যাঘাত ঘটেছে।
মৌলভীবাজারের চা বাগানের শ্রমিক নমিতা বাউরি ডেইলি স্টারকে বলেন, “এই বছর খরা অত্যধিক ছিল। পাতাগুলো শক্ত হয়ে গেছে। প্রতিদিন ২৫-৩০ কেজি পাতা তুলতে পারছি, কিন্তু গত বছর ৫০-৬০ কেজি তুলতে পারতাম।” তাঁর মতো আরও অনেক নারী শ্রমিক একই অভিযোগ করেছেন।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত ছিল ২৭১৬ মিলিমিটার, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
আবহাওয়াবিদ মো. আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে চা উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফিনলে টি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, “চায়ের জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য হলেও, রোদও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে মাটি ক্ষয় হয়ে গেছে, ফলে চা গাছ অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে।”
এদিকে, চা বাগান ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ চৌধুরী জানান, “এ বছর চায়ের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অতিরিক্ত বৃষ্টি, উচ্চ তাপমাত্রা এবং বন্যার প্রভাব উৎপাদনে বড় ক্ষতি করেছে।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রকৌশল ও চা প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন চা শিল্পের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বাগানগুলো সবুজে ঢাকা থাকার কথা কিন্তু বর্তমানে সেগুলো খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “চা উৎপাদনকে টিকিয়ে রাখতে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং নতুন জাতের চা গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”
বাংলাদেশ চা সংসদের এম শাহ আলম জানিয়েছেন, অনেক চা বাগান বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ নারীরা বিকল্প কাজের সুযোগ না পেয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছেন।
তিনি বলেন, “গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ২৩০ টাকা হলেও নিলামে দাম উঠছে ২১১ টাকা। এতে প্রতি কেজি ২০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।”
চা শিল্পের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় এম শাহ আলম সরকারকে চা উৎপাদনকারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সরকার যদি ৪ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ প্রদান করে, তবে চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।”
চা শিল্পের বর্তমান সংকট অত্যন্ত গুরুতর, যা দেশের চা উৎপাদন এবং শ্রমিকদের জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই শিল্পটি রক্ষা করতে হলে সরকারের সঠিক পদক্ষেপ জরুরি।