ত্রৈমাসিক শ্রম শক্তির জরিপ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দেশের মানুষ কাজের ক্ষেত্রে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা নির্ধারণ করা হয়। সহজ কথায়, দেশের কতজন মানুষ কাজ করছে, কতজন কাজ খুঁজছে এবং কতজন কাজের বাইরে আছে-এসব তথ্য এই জরিপ থেকে জানা যায়। জরিপটি প্রতি তিন মাস পর পর করা হয়। যাতে দেশের শ্রম বাজারের হালনাগাদ চিত্র পাওয়া যায়। এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়— তারা কী ধরনের কাজ করছে, কত ঘণ্টা কাজ করছে এবং নতুন কাজের সুযোগ কেমন। এর মাধ্যমে দেশের শ্রমশক্তির চাহিদা ও সরবরাহের একটা পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়। যা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বিভিন্ন জরিপের মধ্যে শ্রমশক্তি জরিপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। এটি দেশের শ্রমবাজারের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে মূল ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে এ জরিপ নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২২ সালে ১৪ তম শ্রমশক্তি জরিপ প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে করা হয় । যা শ্রমবাজার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত এবং হালনাগাদ তথ্য প্রদান করে। এই জরিপের আওতায় ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের পুরুষ ও মহিলা, শহর ও পল্লী অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের ১২৮৪ টি নির্বাচিত এলাকায় দৈবচয়নের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতি এলাকায় ২৪ টি খানা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এক বছরে মোট ৩০ হাজার ৮১৬ টি খানার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ১ লক্ষ ২৩ হাজার িমক৩৬৪ খানায় পৌঁছায়।
বেকারত্বের বর্তমান অবস্থা
২০২৪- এর শ্রমশক্তির জরিপে দেখা গেছে, বেকারত্বের হার সামান্য কমলেও এটি শ্রমবাজারের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে না। বিশেষ করে বেকারত্বের একটি নতুন ধারা তৈরি হয়েছে, যা “আংশিক বেকারত্ব” নামে পরিচিত। এর অর্থ, অনেকে কাজ পেলেও তাদের কাজের পরিমাণ বা আয় পর্যাপ্ত নয়। ফলে তারা আর্থিকভাবে দুর্বল থেকে যাচ্ছে। এ সমস্যার মূলে রয়েছে কর্মসংস্থানের নিম্নমান এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব। আংশিক বেকারত্বের এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও কার্যকর কর্মসংস্থান নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। যাতে তরুণ এবং দক্ষ কর্মীরা তাদের যোগ্যতানুযায়ী কাজ পেতে পারেন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, যারা শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তবে জরিপে উঠে এসেছে যে, এদের বড় অংশের মধ্যে পর্যাপ্ত দক্ষতার অভাব রয়েছে। আধুনিক চাকরির বাজারে প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিশেষায়িত দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও তেমনভাবে শ্রমবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ফলস্বরূপ, শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ কর্মসংস্থানের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে প্রবেশের জন্য তরুণদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ২০২৪- এর জরিপ অনুযায়ী কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এখনও যথেষ্ট নয়। অনেক নারী পরিবার ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছেন না। যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে তাদের অধিকার সুরক্ষিত নয়। এই বৈষম্য দূর করতে নারীদের জন্য সঠিক কর্মপরিবেশ এবং সুবিধা প্রদান জরুরি। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এই খাত কর্মসংস্থানের একটি বিশাল উৎস হলেও এখানে শ্রমিকদের অধিকাংশই ন্যায্য মজুরি বা শ্রমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ত্রৈমাসিক জরিপে দেখা গেছে, অনানুষ্ঠানিক খাত ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু এর সাথে সাথে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের জন্য আরও সুরক্ষিত ও স্বীকৃত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে সরকার এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বিশাল অবদান রাখেন। তবে ২০২৪-এর জরিপে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কিছুটা সংকোচন দেখা দিয়েছে। অনেক গন্তব্যে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। দক্ষতার ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা কঠিন হওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিদেশে কাজ পাওয়া আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা এখন আগামী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকতে হবে।
ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তির চ্যালেঞ্জ
২০২৪ সালের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তির জরিপ ( Quarterly Labor Force Survey) প্রকাশের পর বাংলাদেশের শ্রম বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। প্রথমতঃ জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তির বৃদ্ধির হার কিছুটা স্থবিরতা দেখিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, অনেক যুবক এবং দক্ষ কর্মী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন না। দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে কাজের সুযোগের অভাব এবং বিভিন্ন খাতে দক্ষতার অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। যুবকরা কাজের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু চাকরির বাজারে তাদের দক্ষতা এবং চাহিদার মধ্যে এক বিরাট ফাঁক তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ দেশের গ্রামের শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো অপ্রতিষ্ঠিত। গ্রামের কৃষকদের মধ্যে যারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারছে না, তারা অধিকাংশ সময়েই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে, শহরমুখী হওয়ার প্রবাহ বেড়ে যায় এবং এটি শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। যা নাগরিক জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে।
তৃতীয়ত: সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত শ্রম বাজারের গতিশীলতা নিশ্চিত করা। নীতিমালা এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা এবং চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া দরকার। বর্তমান সময়ে দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে । তাই যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে একটি সুসংগঠিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গড়ে তুলতে হবে।
গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তি, উন্নত সেচ পদ্ধতি এবং বিভিন্ন বিকল্প চাষের প্রবর্তন কৃষকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। এদিকে ঋণ ও অর্থায়নের সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন করা যেতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, ত্রিমাসিক শ্রম শক্তির জরিপ দেশের প্রকৃত অবস্থাই ফুটিয়ে তোলে। তাই এ জরিপ থেকে বোঝা যায় যে, বর্তমানে দেশের অবস্থা কেমন এবং আরো কী করলে উন্নতি করা যাবে। এ জরিপ থেকে আমাদের দেশের শ্রমশক্তির পরিস্থিতি উন্নয়নে কী করা উচিত তার শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত যে, শ্রমশক্তির সঠিক ব্যবহার এবং উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।