বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। দেশটি একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেখানে নতুন নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে, বিলাসবহুল পণ্য, বিশেষ করে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে। উচ্চ আয়ের শ্রেণী ও মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, উন্নত জীবনযাত্রার মান এবং সামাজিক মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কারণে রোলস রয়েস, রেঞ্জ রোভার, বিএমডব্লিউ এবং মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো বিলাসবহুল গাড়িগুলোর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।
রোলস রয়েস, রেঞ্জ রোভার, বিএমডব্লিউ এবং মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো বিলাসবহুল গাড়িগুলো এখন বাংলাদেশের শহুরে জীবনের সামাজিক মর্যাদার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও বিলাসবহুল গাড়ির আমদানি থেমে নেই।
বিশেষত ঢাকা শহরের রাস্তায় এসব গাড়ির উপস্থিতি শুধু আরামদায়ক যাতায়াতের প্রতীক নয় বরং এটি ব্যবহারকারীর সামাজিক অবস্থানেরও একটি চিত্র তুলে ধরে। উচ্চবিত্ত ও উঠতি উচ্চবিত্ত এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা এই ধরনের গাড়ি বেছে নিচ্ছেন, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও বিত্ত শৈলীর প্রকাশ করছে। এর ফলশ্রুতিতে বিলাসবহুল পণ্য, বিশেষ করে উপরে উল্লিখিত বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি আমদানি কিছুটা কমেছে। আগামী বাজেটকে সামনে রেখে সার্বিকভাবে বিলাস বহুল গাড়ি আমদানিতে এই পরিবর্তন স্পষ্ট। চলতি অর্থবছরের ২৮ মে পর্যন্ত দেশে আমদানি হয়েছে ১৬ হাজার ৭৪২টি ব্যক্তিগত গাড়ি, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হওয়া ১৮ হাজার ৩৪৯টি গাড়ির তুলনায় কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নতুন গাড়ি আমদানির পরিমাণ হ্রাসের মূল কারণ, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি। তবে পুরোনো গাড়ির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। যা বোঝায় যে বাজারের একটি অংশ এখনো পুরোনো গাড়ির উপর নির্ভরশীল।
গাড়ি আমদানিতে সামগ্রিকভাবে কিছুটা মন্দা দেখা গেলেও বিলাসবহুল গাড়ির ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। চার ধরনের বিলাসবহুল গাড়ির আমদানিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি ঘটেছে, যা অর্থনৈতিক চাপের মাঝেও এসব গাড়ির প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এই চার ধরনের গাড়ির তালিকায় রয়েছে রেঞ্জ রোভার, বেন্টলি, পোরশে এবং রোলস রয়েসের মতো দামী ও অভিজাত ব্র্যান্ড।
এসব গাড়ির আমদানি বৃদ্ধি দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিলাসবহুল জীবনযাত্রার প্রতি সমাজের এক অংশের আগ্রহ এখনো অটুট। তবে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতের পর দেশে কয়েক বছর ধরে এ ধরনের গাড়ি আমদানি বাড়ছে। জীবাশ্ম চালিত গাড়ির তুলনায় এই সমস্ত গাড়িতে শুল্ক সুবিধা থাকায় এ ধরনের গাড়ি আমদানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশে আমদানি হওয়া দামি গাড়ির তালিকায় রোলস রয়েসের পরই রয়েছে বেন্টলি ও রেঞ্জ রোভার। বেন্টলির একটি গাড়ি আমদানিতে শুল্কসহ মোট খরচ পড়ছে প্রায় ৬ থেকে পৌনে ৭ কোটি টাকা। আর রেঞ্জ রোভার আনতে খরচ হচ্ছে ৫ কোটিরও বেশি। এই বিপুল খরচ সত্ত্বেও বিলাসবহুল গাড়ির প্রতি দেশের উঠতি এক শ্রেণীর মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ২০টি রেঞ্জ রোভার, ৯টি বেন্টলি এবং একটি পোরশে গাড়ি। শুল্ক ও করসহ ৪ কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়ি আমদানি হয়েছে ৫১টি। পাশাপাশি হাইব্রিড এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এই দুই ধরনের গাড়ি আমদানির সংখ্যা পৌঁছেছে ৯ হাজার ১০৩টিতে, যা মোট গাড়ি আমদানির ৫৪ শতাংশ স্থান দখল করেছে। বিলাসবহুল এই গাড়িগুলোর উপস্থিতি দেশের ক্রমবর্ধমান উচ্চবিত্তের রুচি ও সামর্থ্যের প্রতীক।
বিলাসবহুল গাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আরামদায়ক অভ্যন্তর, আধুনিক প্রযুক্তি ও অনন্য ডিজাইন। এসব গাড়িতে ব্যবহৃত হয় উচ্চমানের উপকরণ, যা যাতায়াতের অভিজ্ঞতাকে আরও আরামদায়ক, মনোমুগ্ধকর ও বিলাসবহুল করে তোলে।
বাংলাদেশে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা বাড়ানোর পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। শহরাঞ্চলে জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে অনেকেই নিরাপদ এবং আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি পছন্দ করছেন। তাছাড়া, বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে বিলাসবহুল গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, যা দেশের বাজারে এই গাড়িগুলোর চাহিদা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু উচ্চ আমদানি শুল্ক এই বাজারের প্রবৃদ্ধিকে সংকুচিত করেছে। বাংলাদেশে বিলাসবহুল গাড়ির উপর ৮৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। যা শুধুমাত্র গাড়ির মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে না বরং ক্রেতাদের আগ্রহকেও দমিয়ে রাখছে। ফলে, অনেক ক্রেতা এই শুল্কের কারণে বিকল্প হিসেবে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বিলাসবহুল গাড়ির বাজারের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। দিন দিন উচ্চবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই উচ্চ আয়ের শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের নীতিগত পরিবর্তন, যেমন আমদানি শুল্ক কমানো এবং সার্ভিসিং ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে, এই বাজারে নতুন প্রাণ সঞ্চার হবে। দেশের ক্রেতাদের জন্য এটি শুধু গাড়ি কেনার সুবিধা তৈরি করবে না বরং দেশের অর্থনীতির বিকাশেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা কেবলমাত্র একটি ফ্যাশন নয় বরং এটি উচ্চ আয়ের শ্রেণীর একটি সামাজিক পরিচয় ও আভিজাত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রোলস রয়েস এবং রেঞ্জ রোভার-এর মতো গাড়ি ক্রয়ের মাধ্যমে লোকজন তাদের ব্যক্তিগত বিত্তশৈলী এবং মর্যাদা প্রকাশ করছে। তবে, উচ্চ আমদানি শুল্ক এবং সার্ভিসিং কেন্দ্রের অভাব এই উন্নয়নকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার যদি নীতিগত পরিবর্তন করে। যেমন- শুল্ক কমানো এবং সার্ভিসিং ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়, তাহলে এই খাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বিলাসবহুল গাড়ির চাহিদা আরও বাড়বে। যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।