বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি এক অন্যতম আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে বাস্তবতা হলো দীর্ঘদিন ধরে এই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। যা জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে সময়ের সঙ্গে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং সেবা খাতের মূল্যের ওপর নজর রাখেন। আগের বছর বা মাসের তুলনায় এসব পণ্যের দাম কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা যাচাইয়ের মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতির প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়। মূলতঃ এটি আমাদের জানায় কোন সময়কালে জীবনযাত্রার খরচ কতটা বেড়েছে এবং সাধারণ মানুষ কীভাবে এর প্রভাব অনুভব করছেন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আজ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এক অসহনীয় বোঝায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তাদের যে নানামুখী ব্যয় বাড়ছে, তা পূরণে তাদের আয় যথেষ্ট নয়। ফলে খাদ্য ও মৌলিক প্রয়োজন মেটাতেও তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যারা আগেও সীমিত আয়ে কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন।
এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের জীবনযাত্রায় সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি সামগ্রিক অর্থনীতির উপরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়নের পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের সমস্যা এবং আমদানি নির্ভরতার ফলে বাংলাদেশের বাজারেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের কারসাজির ফলে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতির চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে
বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির চিত্র-
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি আবারও জনগণের জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০.১৫ শতাংশে, যা জীবনযাত্রার ব্যয়ে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে এই হার ৯.৮৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা তুলনামূলক কম হলেও উদ্বেগজনক।
মূল্যস্ফীতির এই পার্থক্য গ্রাম ও শহরের জীবনযাত্রায় বিভিন্ন দিক থেকে প্রভাব ফেলছে। গ্রামীণ অঞ্চলে প্রধানতঃ খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন ব্যয় এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করছে। অন্যদিকে, শহুরে এলাকায় আবাসন, পরিবহন এবং সেবা খাতের ব্যয়বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রা ব্যয় বাড়ছে। এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির জন্য প্রধানত দায়ী বিগত বিদায়ী সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মত মৌলিক পদক্ষেপ না নেওয়া এবং কার্যকর নীতি গ্রহণে কালক্ষেপণ করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ক্রমে স্ফীত হয়েছে। এদিকে বর্তমানে বাজার দর কমার কোন লক্ষণ না থাকায় অন্তর্বতী সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় পদ ক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছেই। এরই মধ্যে আবার বাজারে মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টেনে ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতেই মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। জুলাইয়ে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ১১.৬৬ শতাংশে পৌঁছায়, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরও উদ্বেগজনক, যা প্রায় ১৪.১ শতাংশ। এই উচ্চ হার সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কঠোর প্রভাব ফেলে।
আগস্টে পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি হয়, যখন মূল্যস্ফীতির হার কমে ১০.৪৯ শতাংশে নেমে আসে। যদিও এটি সামান্য স্বস্তির ইঙ্গিত দেয়, তবুও খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনও বড় চিন্তার কারণ। খাদ্যশস্য, তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের জন্য ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ সরকারের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন হবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে কিছুটা সহজ করবে। সরকারের এই উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই, সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা হলে তা জনগণের জন্য একটি বড় স্বস্তির বার্তা হিসেবে কাজ করবে।
মূল্যস্ফীতির কারণ ও বৈশ্বিক প্রভাব-
বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। এটির কারণ সাধারণত দুটি: চাহিদা-জনিত এবং সরবরাহ-জনিত। এই দুটি কারণই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির গতিপথ নির্ধারণ করে, তবে তাদের ভূমিকা ও প্রভাব আলাদা। যখন গ্রাহকদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন তা সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে একটি “চাহিদা-জনিত” মূল্যস্ফীতি তৈরি করে।
অন্যদিকে, পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় বাড়লে সরবরাহ-জনিত মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ – জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা পরিবহন ও উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়, যা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করে। এইভাবে মূল্য বৃদ্ধি গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।
তাছাড়া মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা এবং আমদানি খরচে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এবং কাঁচামালের মুল্য বৃদ্ধি, করোনা পরবর্তী সরবরাহ চেইনে অসামঞ্জস্যতা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ইত্যাদি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে আমদানি নির্ভর পণ্যের দামও লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। এর ফলে আমদানি পণ্যের সাথে স্থানীয় বাজারেও চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি উৎপাদনে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সারের সংকটও মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। একদিকে তাদের আয় কম, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের সঞ্চয় তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্য, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলোর মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের সন্তানদের শিক্ষা খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা খরচ মেটাতে না পারায় তাদের পরিবার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি প্রদান, খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি এবং বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বা স্বল্প পরিসরে থাকায় তা প্রয়োজনীয় মাত্রায় কার্যকর হচ্ছে না। অনেক সময় বাজারে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং দুর্নীতির কারণে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়, যা সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত মূল্য দিতে বাধ্য করে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সঠিক বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং মনিটরিংয়ের অভাবের ফলে সরকারী পদক্ষেপগুলোর কাঙ্ক্ষিত সুফল অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সমাধানের প্রয়োজনীয়তা-
মূল্যস্ফীতির এই বোঝা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের রক্ষা করতে হলে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন এবং শক্তিশালী বাজার মনিটরিং সিস্টেম প্রয়োজন। স্থানীয় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সহায়তা প্রদান, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি এবং উন্নত পদ্ধতি প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আমদানি নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদনে জোর দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করলে তা মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সাহায্য করবে। এছাড়া, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি। দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের আয় বৃদ্ধি করা জরুরি। পাশাপাশি, সরকারী ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। বিশেষতঃ খাদ্য সহায়তা, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো প্রয়োজন।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের রক্ষা করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বাজার মনিটরিং সিস্টেম এবং ট্রান্সপারেন্সি বাড়ানো জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন।
মূল্যস্ফীতির ভারে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে, তা জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সঠিক উদ্যোগ, ন্যায়সঙ্গত বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমেই আমরা আমাদের সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের জন্য একটি স্থিতিশীল ও উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে পারব।