প্রতিবছর রোজার আগমুহূর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এবার বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মনের ভেতর জমে থাকা পুরোনো ভয় কাটছে না। রোজা শুরুর পরপরই কিছু পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
যদিও এ বছর ভরপুর ফলনের কারণে পানির দরে কেনা গেছে সবজি। ফলে অন্যসব পণ্যের দরও কিছুটা নাগালে। তবে রোজার আগের এই স্বস্তি একাই কেড়ে নিয়েছে সরবরাহ সংকটে পড়া ভোজ্যতেল।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে সবজি কেনার পর নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে সামনের সপ্তাহে কী হয়, সেটি দেখার বিষয়। রোজা শুরু হলে তো ব্যবসায়ীরা বেতাল হয়ে যায়।’
ভোজ্যতেল নিয়ে একজন ভোক্তা বলেন, ‘মহল্লায় না পেয়ে কারওয়ান বাজারে আইলাম। আট-দশটা দোকানে খুঁজেও তেল পাইলাম না। এই তেল গেল কই?’
তবে বাজারে পণ্যের দাম একেবারে বাড়ছে না, তেমনটা নয়। এ সপ্তাহে কিছুটা মাথাচাড়া দিয়েছে ব্রয়লার মুরগি, ছোলা, বেগুন, লেবু, শসা ও বিদেশি ফল। এগুলোর বেশির ভাগই ইফতারির পণ্য।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেলের বাজারে চলছে অরাজকতা। বড় আকারে শুল্ককর ছাড় দেওয়া হলেও আমদানিকারকরা ভোক্তার সঙ্গে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ থেকে বের হতে পারেননি। নানা অজুহাতে ফের সামনে এনেছেন দর বাড়ানোর আবদার। যদিও তা আমলে নিচ্ছে না সরকার। ফলে বিলম্ব আমদানি দেখিয়ে সরবরাহ কমানোর অভিযোগের তীরে বিদ্ধ তারা।
গেল সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমদানিকারকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি যে ‘কথার কথা’ ছিল, তা ক্রেতারা টের পেয়েছেন বাজারে গিয়েই। গতকাল বুধবার ঢাকার মহাখালী, হাতিরপুল, তেজকুনিপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের সংকট আরও প্রবল হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১০ দোকান খুঁজলে মেলে দুই-এক দোকানে। একসঙ্গে পাঁচ লিটার কিনলে দামে কিছুটা সাশ্রয় হয়। সে জন্য এই বোতলের চাহিদা বেশি। খোলা সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক দেখা গেলেও কিনতে গিয়ে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
সরকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ১৮০ থেকে ১৮২ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের আবদুর রব স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. নাইম বলেন, পাইকারিতে প্রতি লিটার কেনা পড়ে ১৭৫ টাকার বেশি, এর সঙ্গে আছে অন্যান্য খরচ। এ জন্য বাড়তি দরে বিক্রি করতে হয়।
কারওয়ান বাজারের পুষ্টি ব্র্যান্ডের ডিলার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, তবে স্বাভাবিক হয়নি। যেখানে দৈনিক দরকার ২০ কার্টন, দিচ্ছে ১০ কার্টন। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ সংকট রয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই-তিনটা প্রতিষ্ঠানের মিল বন্ধ। ফলে অন্য কোম্পানির ওপর চাপ বেড়েছে, সে জন্যই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও মিলছে না ভোজ্যতেল। খুচরা বাজারে হন্যে হয়ে খুঁজেও তেল কিনতে পারছেন না ভোক্তা। রমজান ঘনিয়ে এলেও স্বাভাবিক হচ্ছে না সরবরাহ। বেশির ভাগ বাজারে এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলছে না। কয়েকটি স্থানে পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
এ ব্যাপারে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, মাত্র একটি কোম্পানির কিছু তেল এসে বন্দরে পৌঁছেছে। মেঘনার একটি জাহাজ আসবে শুক্রবার, আরেকটা আসবে ৬ মার্চ। দেরিতে তেল আসার কারণে বাজার ধরতে পারছি না। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছি।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অনেক দিন ধরেই বোতলজাত সয়াবিন বাজার থেকে উধাও। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে এগুলো উধাও করেছেন। এ নিয়ে রিফাইনারগুলো এবং তাদের ডিস্ট্রিবিউটররা একে অপরের ওপর দোষারোপ করছেন। তবে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। সরকারের উচিত, রমজানের আগে তদারকি জোরদার করা। যাতে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন।
তবে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঘাটতি নিয়ে ভোক্তার অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। তিনি বলেন, তেলের সংকটের বিষয়টি সঠিক নয়। বাজারে অভাব নেই। সব জায়গায় ভরপুর তেল আছে। শুধু ভোজ্যতেল নয়, কোনো পণ্যের সংকট নেই।
এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কার্যদিবসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রমজানে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন অগ্রাধিকার কর্মসূচি। একই সঙ্গে টিসিবির পণ্য বিক্রির তদারকি জোরদার করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
কিছুটা স্বস্তির খবর আছে চিনি, সবজি, আলু, পেঁয়াজে। ফলন বেশি হওয়ায় এখন আলুর কেজি নেমেছে ২০ টাকায়। গত বছর এ সময় আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকার মতো। একই পরিস্থিতি পেঁয়াজে। গত বছর এ সময় পেঁয়াজের কেজি ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এখন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে দাম। মান ও জাতভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। সবজির দামও বেশ কম। টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে। কাঁচামরিচের কেজি কেনা যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। তবে গত চার-পাঁচ দিনের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গত বছর এ সময় চিনির কেজি ছিল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। এবার তা কেনা যাচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।