বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় এখনো প্রধানত প্রচলিত বাজারগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তবে অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে প্রত্যাশা অনুযায়ী রপ্তানি বাড়ছে না বরং এসব বাজারের অংশ বিশ্ববাজারে মোট রপ্তানি আয়ের তুলনায় কমছে। চলতি অর্থবছরের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির চিত্রও মূলত প্রচলিত বাজারকেন্দ্রিক।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গুটিকয়েক বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতা রপ্তানি প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর বাস্তব উদাহরণ।
তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রচলিত বাজার বলতে সাধারণত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত ও তুরস্কসহ অন্যান্য দেশগুলোকে অপ্রচলিত বাজার হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশে ছড়িয়ে থাকলেও অপ্রচলিত বাজারের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করেছিলেন। যদিও ইইউভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে তখনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি তবে ভবিষ্যতে তা করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের শুল্ক নীতি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে যার প্রভাব বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপরও পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে শুল্ক যুদ্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে যা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ইইউতে পোশাক রপ্তানি ১৩ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৩৪২ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে ইইউর অংশ বেড়ে ৫০ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৯ দশমিক ৭০ শতাংশ।
একক দেশ হিসেবে প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে এই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যার ফলে বাজারের অংশ বেড়ে ১৮ দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৫০৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার।
কানাডায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ, ফলে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ৩ দশমিক ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যের বাজারে এই হার কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
অন্যদিকে অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। ফলে এসব বাজারের সম্মিলিত হিস্যা কমে ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত আট মাসে অপ্রচলিত বাজারে মোট ৪৫৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪২৬ কোটি ডলার।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পশ্চাত সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য সহায়ক সেবা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও তিনি উল্লেখ করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে কৌশলগত উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার বৈচিত্র্য বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে উৎপাদন সক্ষমতা ও পণ্যের মান উন্নত করা জরুরি। পাশাপাশি রপ্তানির জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।