দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিন সম্প্রতি এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় বরং গোটা এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবাজার হিসেবে গড়ে উঠছে। যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিপরীতে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভিসা জটিলতায় পড়ে বিদেশি রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ছেন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপুল সম্ভাবনা ও নজিরবিহীন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ফোর্বসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। দেশটির মাথাপিছু আয় ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে বেশি। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে তরুণ ও সক্রিয় জনশক্তি, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং দ্রুত নগরায়ণ। এসব উপাদান বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকেও অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে যা জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ। অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয়, এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। ১৯৫৪ সালে হামিদুর রহমান সিনহার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় একমি ল্যাবরেটরিজ—যা দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে পথিকৃৎ। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী ও কার্যকর ওষুধ খাত।
দেশি উদ্যোক্তাদের হাত ধরেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় উদ্ভাবনী পরিবর্তন আসছে। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি যিনি যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন গড়েছিলেন। তার মায়ের অসুস্থতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন প্রভা হেলথ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি একটি আধুনিক, মানসম্পন্ন এবং এক ছাতার নিচে সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রভা হেলথ এখন দেশের অন্যতম সফল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান যার মূল লক্ষ্য হলো দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রদান।
তবে দেশে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগত দুর্বলতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে প্রতি এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তুলনামূলকভাবে ভারতের চেয়ে এটি বিশাল ঘাটতি এবং এই খাতটিতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ বিদ্যমান। স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও মানবসম্পদে ঘাটতির বিষয়টিও স্পষ্ট—প্রতি ১,০০০ জনে মাত্র ১টি হাসপাতালের বেড এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যাও আশানুরূপ নয়।
এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশে নতুন ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাব ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে যা বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে এখনো যারা বিনিয়োগে আসেননি, তাদের জন্য এটি ‘আর্লি মুভার’ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। সরকারও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে শতভাগ মালিকানা ও করছাড়সহ নানা প্রণোদনা দিচ্ছে।
আরেকটি বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য বিমা। বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র ১ শতাংশ জনগণের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে, ফলে বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো এই সেবার বাইরে। স্বাস্থ্য বিমার প্রসার ঘটিয়ে এই খাতেও বিনিয়োগকারীরা নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারেন।
এছাড়া ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা খাতও দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই খাত প্রতিবছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এর বাজার ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যার ফলে রিমোট কেয়ার, টেলিমেডিসিন এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তি নির্ভর সেবায় বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকপথে দাঁড়িয়ে। সামগ্রিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও সরকারি নীতির সমন্বয়ে এটি শুধু দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না বরং বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্যও একটি রত্নভাণ্ডার হয়ে উঠতে পারে।