প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় স্বস্তি ফিরে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২ হাজার ৪৫৪ কোটি মার্কিন ডলার যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪২ কোটি ডলার বা ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির এই ধারায় রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং বাজারে ডলারের সংকট অনেকটাই কেটেছে। বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে ডলার ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে যা আগের সময়কার ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘ডলার হাহাকার’ থেকে মুক্তির ইঙ্গিত দেয়।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অর্থপাচার প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাঠানোর প্রবণতা কমেছে। বর্তমানে খোলাবাজার ও ব্যাংকিং চ্যানেলের ডলার দরের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। বরং ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ বেশি অর্থ পাচ্ছেন যা ব্যাংকিং মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে তাদের আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করছে।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির সময় লকডাউনের কারণে হুন্ডি কার্যক্রমে বাধা আসায় তখনও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার যা ছিল আগের বছরের তুলনায় ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এক সময় প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ আসত হুন্ডির মাধ্যমে। বিদেশে অবস্থানরত পুঁজি পাচারকারীরা এসব ডলার কিনে নিত। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর এই পাচার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। হুন্ডির চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় এখন রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসছে আনুষ্ঠানিক পথে। তার মতে, যদি সরকার অর্থপাচার ঠেকাতে বর্তমান অবস্থান বজায় রাখতে পারে, তাহলে আগামী মাসগুলোতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স বৃদ্ধিই দেশের অর্থনীতিকে বর্তমানে একটি মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থানে রেখেছে। এই প্রবাহ বজায় থাকলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও উন্নত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস বাদে বাকি সব মাসেই আগের অর্থবছরের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই এসেছে ২৭৫ কোটি ডলার যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৭১ কোটি ডলার বা ৩৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। এপ্রিল মাসের এই রেমিট্যান্স দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল গত মার্চে ৩৩০ কোটি ডলার এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত ডিসেম্বর, ২৬৪ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ ছাড়িয়ে গেছে আগের পুরো অর্থবছরের মোট অঙ্ককে। গত অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্সের পাশাপাশি দেশের রপ্তানি আয়ের দিকেও আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। এই দুই উৎস রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে টানা ২০ মাস পর আবারও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। গত ৩০ এপ্রিল এই রিজার্ভ দাঁড়ায় ২২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে যদিও এরপরদিন এটি কিছুটা কমে ২১ দশমিক ৯৭ বিলিয়নে নেমেছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২২ সালের আগস্টে, ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আমদানি চাপে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ কমতে থাকে এবং সাবেক সরকারের মেয়াদ শেষের সময় গত বছরের জুলাই শেষে তা নেমে আসে ২০ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। তবে বর্তমান সরকারের শাসনামলে গত ৮ আগস্টের পর থেকে আর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। বরং আগের সরকারের রেখে যাওয়া ৩৭০ কোটি ডলার বকেয়ার একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। তবুও রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, অর্থপাচার ঠেকাতে গৃহীত নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াও চলছে। পাশাপাশি প্রবাসীদের দেশপ্রেমও ব্যাংকিং মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে যা ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছে।
ব্যাংকারদের বক্তব্যেও মিলছে সেই আশার বার্তা। তাদের মতে, আগের সরকারের আমলে আমদানির ক্ষেত্রে যেখানে ডলারের দাম উঠেছিল সর্বোচ্চ ১২৭ টাকা সেখানে এখন তা দীর্ঘদিন ধরে ১২২ টাকায় স্থিত রয়েছে। আমদানি, ভ্রমণসহ নানা বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করেছে বর্তমান সরকার। ফলে আমদানিকারকরা এখন সহজেই ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন। ডলারের সংকটে পূর্বে যেসব আমদানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল, বর্তমানে তা স্বাভাবিক হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আমদানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে তারা মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগ যদি না কমে তাহলে ডলার বাজারে স্বস্তি আরও বাড়বে।
সব মিলিয়ে, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতিকে আরও সুসংহত করছে। রিজার্ভও পুনরুদ্ধারের পথে। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল ভিত্তি লাভ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।