বাজারে ভোজ্যতেলের দাম ক্রমাগত বাড়ার কারণে দেশের কৃষকদের মধ্যে তেলবীজ চাষের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলছে। শুধু পরিবারে ব্যবহারের জন্যই নয় বাণিজ্যিকভাবে তেলবীজ চাষ এখন বেশ লাভজনক হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছরে সরিষার চাষ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩.৩৯ শতাংশ জমির বর্ধিত হয়ে সরিষার চাষ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সাত লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হলেও চলতি বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার হেক্টরে।
সরিষার পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চিনা বাদামের চাষ, যা ১৪.৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্যমুখীর চাষও কম নয় গত পাঁচ বছরে তা বেড়েছে ১৩.৭৭ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য তেলবীজ যেমন তিল ও সয়াবিনের চাষেও যথাক্রমে ১১ হাজার ও সাত হাজার হেক্টর জমির বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। এই তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং থেকে পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের ছয় জেলায় মোট ৪২ হাজার ৪৯২ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়েছে। এ ছাড়াও এক লাখ আট হাজার ২৫৩ হেক্টর জমিতে সরিষা, এক লাখ নয় হাজার হেক্টর জমিতে চিনা বাদাম এক লাখ এক হাজার হেক্টরে তিল এবং আট হাজার ৪৪৪ হেক্টরে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে।
বরগুনা জেলায় সূর্যমুখীর চাষ সবচেয়ে বেশি। বরগুনার অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বদরুল আমিন জানান, গত তিন বছরে এ অঞ্চলে সূর্যমুখীর চাষ বেড়েছে। বর্তমানে এই ফসল ২২৪ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। ২০২২ সালে যেখানে তিন হাজার ৩৭৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছিল, সেখানে চলতি বছর তা বেড়ে তিন হাজার ৬০০ হেক্টরে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, ‘লবণাক্ত জমিতে কম খরচে সূর্যমুখী উৎপাদন সম্ভব হওয়ায় এখানকার কৃষকেরা বেশি এ ফসল বেছে নিচ্ছেন।’
অপরদিকে পটুয়াখালী জেলায় গত তিন বছরে তেলবীজ চাষে ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা গেছে। এ সময়ে তেলবীজ চাষে ৪২ গুণ বেড়েছে। সূর্যমুখীর চাষ ১১৬ গুণ, সয়াবিনের চাষ ১১২ গুণ, চিনা বাদামের চাষ ৩০ গুণ এবং সরিষার চাষ ৪২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি মৌসুমে পটুয়াখালীতে ১১ হাজার ১৩২ হেক্টর জমিতে তেলবীজ চাষ হয়েছে।
জেলার দশমিনা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রবি ফয়সাল জানান, প্রতি হেক্টরে কমপক্ষে দুই টন সূর্যমুখীর ফলন হয় এবং প্রতি কেজি থেকে প্রায় ৪০০ গ্রাম তেল সংগ্রহ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও সঠিক পরামর্শের মাধ্যমে এই অর্থকরী ফসল আঞ্চলিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।
কলাপাড়া উপজেলার সূর্যমুখী চাষি রাবেয়া বেগম জানালেন, তার জমি দীর্ঘ ১০ বছর পতিত ছিল। মূলত বর্ষাকালে ধান চাষ হতো, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত জমি হওয়ায় অন্য কোনো ফসল হতো না। এই বছর তিনি মোট জমির ৬৬ শতাংশে সূর্যমুখী চাষ করেছেন এবং ফলন ভালো হওয়ায় তিনি মনে করছেন পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ হবে।
গলাচিপা উপজেলার আরেক চাষি হাশেম মুন্সি জানিয়েছেন, বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার ফলে পরিবারের ভোজ্যতেলের খরচ বেড়ে গেছে। তাই নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণ ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে বেশি জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছেন যা আগের তুলনায় বেশি।
বাউফল উপজেলার কৃষক মেহেদী হাসান বলেন, ‘পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকি তেল আমি বিক্রি করি। প্রতি বছর সারা বছরে প্রায় ৪৫০ লিটার সূর্যমুখী তেল বিক্রি করি, যা প্রতি লিটার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সরিষার তেলও প্রতি লিটার ২৩০ টাকায় বিক্রি করি, বছরে প্রায় ২০০ লিটার।’
পটুয়াখালীর কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, তারা কৃষকদের উৎপাদিত তেলবীজ বাজারে সহজে বিক্রির জন্য বিভিন্ন তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন যাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। এতে করে তেলবীজ চাষে আরও উৎসাহ তৈরি হচ্ছে।
বরিশালের তিল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান অমৃত কোম্পানির মানবসম্পদ কর্মকর্তা গোকুল চন্দ্র জানান, পূর্বে তারা বাজার থেকে তেলবীজ কিনে প্রচলিত ঘানিতে ভাঙিয়ে বাজারজাত করত। কিন্তু এখন তারা তেল উৎপাদনের জন্য অটোমেশিন বসিয়েছে যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন এনেছে।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ জেলায় সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলবীজ চাষে কৃষকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই অঞ্চলে প্রায় ৪০ কোটি টাকার সূর্যমুখীর তেল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সূর্যমুখী থেকে সহজে তেল বের করার জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে মাড়াই মেশিনও বিতরণ করা হয়েছে।’
বরিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, ‘সরকার ভোজ্যতেল আমদানি ৪০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে তেলবীজ চাষ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরের তুলনায় চলতি বছরে তেলবীজ উৎপাদন প্রায় ২৪০ শতাংশ বেড়েছে।’
দেশে ভোজ্যতেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বাজার মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তেলবীজ চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বাড়ছে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।