অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যখন চরমে, তখনই আমানতকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে থাকেন। ২০২৪ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে সেই পুরনো চিত্রই আবার ফিরে আসে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ব্যাংকে সরিয়ে নেন গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর শুধু ১০টি ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা তুলে নেন আমানতকারীরা। এই বিপুল অর্থ মূলত ভালো পারফর্মিং ব্যাংকগুলোতে সরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে আস্থার ঘাটতি তুলনামূলকভাবে কম।
ভালো ব্যাংকে আমানতের জোয়ার-
- ব্র্যাক ব্যাংকে আমানত ৩২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।
- সিটি ব্যাংকে বেড়েছে ৩১ শতাংশ, দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
- যমুনা ব্যাংকে বৃদ্ধি ২৭ শতাংশ, এখন ৩১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
- মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক— এদের সবার আমানত বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।
- প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার শেয়ারদরও বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি।
হুমকিতে পড়া ব্যাংকগুলো-
তবে অন্যদিকে, কিছু ব্যাংকের জন্য ২০২৪ ছিল একপ্রকার ‘ভরাডুবির বছর’।
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল):
আমানত ১৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।
২০২৩ সালে যা ছিল ৩৫ হাজার ৬৮৫ কোটি।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান বলেন,“এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ততার খবরে গ্রাহকরা আতঙ্কিত হন। তবে ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল হয়েছে।”
- ন্যাশনাল ব্যাংক:
আমানত কমেছে ৫ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ৪২ হাজার ৬১০ কোটি থেকে নেমে এসেছে ৩৬ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকায়। - বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক:
আমানত হ্রাস পেয়েছে ১০ শতাংশ, যা প্রায় ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা।
‘রেড জোন’ আতঙ্কে এবি ব্যাংকেও ধস
২০২৩ সালে যেখানে এবি ব্যাংকের আমানত তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেড়েছিল। ২০২৪ সালে তা তিন হাজার ১৮৫ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকায়।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) জেড এম বাবর খান জানান,
“আমাদের ব্যাংক ‘রেড জোনে’ এমন গুজব ও সম্ভাব্য মার্জার প্রসঙ্গে শঙ্কায় পড়ে গ্রাহকরা টাকা তুলে নেন। এখন পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।”
তার দাবি,
“চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আমানতের বুকিং হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা।”
বিদেশি ব্যাংকও ছাড় পায়নি-
দেশের সবচেয়ে লাভজনক বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডও এই টালমাটাল পরিস্থিতির বাইরে নয়। এ ব্যাংকের আমানত কমেছে নয় দশমিক ৯৭ শতাংশ। এখন দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি জানিয়েছে,
“এয়ারলাইনস শিল্পে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং কিছু এককালীন লেনদেন সাময়িকভাবে আমানতে প্রভাব ফেলেছে।”
নতুন ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়ানো-
বেশ কয়েকটি নতুন ব্যাংক গত বছর ভালো পারফর্ম করেছে।
মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক— সবার আমানত বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।
‘আস্থা’ এখন সবচেয়ে বড় মাপকাঠি-
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (BIBM)-এর অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন,
“ভালো ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল না। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা সরিয়ে নেওয়াতেই এ উল্লম্ফন।”
তার মতে,
“রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা সামনে আসে। গ্রাহকরা তখন সুদের হার না দেখে সুশাসনের দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
‘ভালো ব্যাংকই এখন নিরাপদ’
একটি ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা জাকির হোসেন গত বছরের আগস্টে তার সঞ্চয় তুলে নেন একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক থেকে।
তিনিও বেছে নেন এক ‘ভালো’ ব্যাংককে, যা আস্থার জায়গায় এগিয়ে।
তাঁর মতো হাজার হাজার আমানতকারী একই পথ অনুসরণ করেন।