গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের পতনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়লেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে ইতিবাচক সাড়া দেখা গেছে। তবে মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত এখনও স্থবির রয়েছে। উচ্চ সুদ, ডলার সংকট ও বিনিয়োগের অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচু পর্যায়ে নেমে এসেছে। কর আদায়ে বড় লক্ষ্য থাকলেও রাজস্ব সংগ্রহে গতিশীলতা দেখা যাচ্ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পেয়েছে। তবুও রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক লেনদেনে কিছু উন্নতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে- রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স, রিজার্ভে স্বস্তি, ঋণ পরিশোধে সাফল্য, বিদেশি বিনিয়োগ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উন্নতি দেশের অর্থনীতিকে সামান্য স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতা কাটাতে না পারলে এই অগ্রগতি টেকসই হবে না।
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের মতে- উচ্চ সুদের হার, ক্রমাগত বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতের অচলাবস্থা কাটছে না। বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে, উৎপাদন কমে গেছে, আর ব্যাংক ঋণও সীমাবদ্ধ। ফলে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে প্রত্যাশিত গতি আসছে না।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত জুনে ৬.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। করোনার সময়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের ওপরে ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন- ‘বর্তমান সরকার ব্যবসায়ীদের আস্থায় নেয়নি। বেসরকারি খাতের প্রতি নজর কম। এজন্য ব্যবসায়ীরা ভুগছেন। বেসরকারি খাতে আস্থার অভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে গেছে। নির্বাচনের ঘোষণা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বড় আকারে বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা ৪২.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এনবিআরের ইতিহাসে অন্যতম বড়।
ভ্যাট খাতে ৩০.৪৯ শতাংশ এবং কাস্টমস ডিউটিতে ২৯ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। গত অর্থবছরে আদায় হয়েছিল তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি তখন মাত্র ২.২৩ শতাংশ ছিল, যা ইতিহাসে অন্যতম নিম্ন।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন- ‘রাজস্ব আদায়ে সফল হতে হলে দেশের অর্থনীতি ভালো থাকতে হবে। কিন্তু গত বছর ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন কমেছে। কর আদায়ে গতিশীলতা নেই। ব্যবসায়িক পরিবেশ স্থিতিশীল হয়নি। উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, মুনাফা কমেছে। এসব কারণে ব্যবসাগুলো অতিরিক্ত কর দিতে পারছে না। এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, এডিপি বাস্তবায়নে দুর্বলতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও ব্যবসার মন্দা দায়ী।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি আয় ২৪.৯ শতাংশ বেড়ে ৪৭৭ কোটি পাঁচ লাখ ডলার হয়েছে। তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৩৯৬ কোটি ২৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪.৬৭ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় ৮.৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যায়। জুলাইয়ে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় ৩০৩২ কোটি ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ডলার সংকট কমেছে। ব্যবসায়ীরা এলসি সহজে খুলতে পারছেন।
সরকার চলতি বছরে ৪.০৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করেছে। পুরনো ঋণ পরিশোধে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নতুন ঋণ চুক্তি মাত্র ৮৩৩ কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ৩২৯ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। আগের বছরগুলোতে যেখানে বড় ঘাটতি ছিল, এবার রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের কারণে ভারসাম্য ইতিবাচক।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি আর অনিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকব্যবস্থায় ফের আস্থা ফিরে আসছে। মে মাস পর্যন্ত ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। বছরে আমানত বেড়েছে ৭.৭৩ শতাংশ।
২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ৮৬৫ মিলিয়ন ডলার, যা আগের ত্রৈমাসিকের চেয়ে ৭৬ শতাংশ বেশি। মাথাপিছু আয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে দুই হাজার ৮২০ ডলার হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৮২ ডলার বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় ৪.০২ শতাংশ বেশি। অর্থবছর শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৯৭ শতাংশ, আগের বছরের ৪.২২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়েছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের দুর্বল অগ্রগতি এর কারণ।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন- ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে অর্থনৈতিক পতন চলছিল। তৎকালীন সরকারের দুর্বল নীতি ও অযোগ্যতা দায়ী। এখন পতন রোধ হয়েছে, কিন্তু প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি।’ তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি কমিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কার অর্থনীতিকে সহায়তা করেছে। তবে বর্তমান সরকার বেসরকারি খাতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। কার্যকর ডায়ালগ হয়নি।

