গাজীপুরে দুস্থ শিশুদের জন্য আধুনিক ডরমিটরি ও বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু শিশুদের সেখানে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তারা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, টিনশেড ঝুপড়িতে থাকতে বাধ্য, যেখানে বৃষ্টি ঢুকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্যই যদি অসৎ হয়, তাহলে দুস্থ শিশুদের নিরাপদ আবাসনের জন্য তৈরি ভবনেও লোভীদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়তে পারে, এতে খুব বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
গাজীপুরে দুস্থ শিশুদের জন্য প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক ডরমিটরি ও বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলেও সেখানে ঠাঁই হয়নি তাদের। জরাজীর্ণ টিনশেড ভবনেই থাকতে হচ্ছে শিশুদের, যে টিনশেড দিয়ে চুইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে শিশুদের। অথচ তাদের জন্য নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ ভবন পড়ে আছে অব্যবহৃত। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা প্রকাশ পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক একটি পরিদর্শন প্রতিবেদনে। দেখা যাচ্ছে, শিশুদের জন্য ডরমিটরি নির্মিত হলেও তারাই উপেক্ষিত আর বাস্তবে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে কর্মকর্তাদের আবাসন।
মূলত প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ৪০০ শিশুর নিরাপদ আবাসন। সেই অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ডরমিটরি ভবন। অথচ দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছয়তলাবিশিষ্ট তিনটি আবাসিক ভবন। এখানে রয়েছে দুই স্তরের ৬০টি ফ্ল্যাট। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৯ জন। অর্থাৎ ৪১টি ফ্ল্যাট বেশি নির্মাণ করা হয়েছে। বাকিগুলো কী কাজে ব্যবহার হবে, তার কোনো যৌক্তিক উত্তর নেই প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের কাছে।
মূলত ২০১৯ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ‘দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নেয়। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার দুস্থ শিশুদের পুনর্বাসনসহ শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৮২ কোটি টাকা। তবে তা বাস্তবায়নে ধীরগতি ও জটিলতার কারণে মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ কোটির বেশি। সবশেষ এক বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির (জুন ২০২৬ পর্যন্ত) প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পর্যালোচনায় জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় একটি ডরমিটরি ভবন, তিনটি আবাসিক ভবন এবং একটি একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। কিন্তু এসব ভবন নির্মাণের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ডরমিটরি ভবনটি এক বছর ধরে পড়ে আছে। দরজা-জানালা, টাইলস, ফিটিংসসহ সব কাজ শেষ হলেও ভবনটি হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে শিশুদের থাকতে হচ্ছে পুরোনো জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরে। এ ছাড়া প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অনিয়ম ধরা পড়েছে লিফট নিয়ে।
দেশে সরকারি প্রকল্পে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনা মানুষকে যতটা না বিস্মিত করে, তার চেয়ে বরং বেশি করে যদি এসব না ঘটে! দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা এবং অলিখিত নিয়ম! বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ পরিচালনার পুরো সময়টায় প্রকল্পসংক্রান্ত যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির বীভৎস চেহারা বেরিয়ে আসে, তার কিছু কিছু ছিল অবিশ্বাস্য। এ প্রকল্পটিও বিগত সরকারের সময়েরই। দুস্থ শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্পটি আজও শিশুদের বসবাসের ব্যবস্থা না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের প্রত্যাশা, নির্মিত ভবনটি দ্রুত বসবাসের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি প্রকল্পে যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, এর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: কালবেলা

