ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে শম্ভুগঞ্জে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। লক্ষ্য ছিল বৃহত্তর অঞ্চলটিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু গ্যাস সংকটে সেই কেন্দ্র এখন প্রায় অচল। বর্তমানে এর উৎপাদন ক্ষমতা (প্লান্ট ফ্যাক্টর) নেমে এসেছে মাত্র ১৫ শতাংশে।
এ অবস্থায় একই এলাকায় গ্যাসনির্ভর আরও একটি ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুটি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকার বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান গ্যাস সংকট না কাটলে এই বিশাল বিনিয়োগও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) বাস্তবায়ন করছে ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি। আর গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস সংকটের মধ্যেই নতুন গ্যাসভিত্তিক প্রকল্প নেওয়া বিদ্যুৎ খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে তিনটি ও খুলনার রূপসায় একটি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলেও পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় সেগুলোও পুরোপুরি চালু রাখা যাচ্ছে না।
আরপিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ময়মনসিংহ ৩৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ডুয়াল ফুয়েল (গ্যাস ও ডিজেল) প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি প্রায় ৭১ শতাংশ। চীনের হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। ২০২৬ সালের জুনে প্রকল্পটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে আরপিসিএল।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে গ্যাস টারবাইন জেনারেটর, ইনসুলেশন কভার, হাই প্রেসার পাইপলাইন ও ফিড ওয়াটার পাম্প স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। চলছে ভবন, সাবস্টেশন, কেমিক্যাল বিল্ডিং, ড্রেনেজ ও ওয়েস্ট ওয়াটার পাইপলাইনের কাজ।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে গ্যাস সরবরাহের জন্য ৫৫৩ কোটি টাকায় নির্মিত হচ্ছে ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ২০ ইঞ্চি ব্যাসের সঞ্চালন পাইপলাইন। গাজীপুরের ধনুয়া থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত এ লাইন স্থাপন করছে জিটিসিএল। পাইপলাইনের মাধ্যমে ৩৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রসহ ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। তিতাস গ্যাস এ সরবরাহ দেবে।
তবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহ নির্ভর করছে পেট্রোবাংলার বরাদ্দের ওপর। অতিরিক্ত গ্যাস পেলে সরবরাহ সম্ভব, না হলে তা চ্যালেঞ্জিং হবে।’
ধনুয়া-ময়মনসিংহ পাইপলাইন প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত হয়। নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গ্যাসের ঘাটতি কাটাতে না পারলে ৩৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্র চালু হওয়ার পরও এর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার সম্ভব হবে না। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ।
১৯৯৭ সালে নির্মিত শম্ভুগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি একসময় ময়মনসিংহের প্রধান বিদ্যুৎ উৎস ছিল। তিন ধাপে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় নির্মিত কেন্দ্রটি ২০০৭ সালের পর থেকে গ্যাস সংকটে জর্জরিত। বর্তমানে এর উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।
আরপিসিএলের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রটির কিছু মাসে উৎপাদন ৪০ মেগাওয়াটের নিচে নেমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৪৫ শতাংশ, আগের বছর ছিল ৬৫-৭০ শতাংশ।
ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী এএইচএম রাশেদ বলেন, ‘গত তিন-চার মাস ধরে ৩২ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন ৪২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার, কিন্তু পাওয়া যায় মাত্র ৯ মিলিয়ন ঘনফুট। শুধু শুক্রবার ও শনিবার শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন কিছুটা বাড়ে।’
এ বিষয়ে আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নাজমুস সায়াদাতের মন্তব্য জানতে চেষ্টা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

