গত এক বছরে বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) প্রকাশিত বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ। উদ্যোগটিতে সহায়তা করেছে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি)।
গুলশানে এমসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ৮০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৫০টি অংশ নেয় এই জরিপে, যেখানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জরিপে দেখা যায়, নিয়ন্ত্রক তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বাণিজ্য সুবিধা, প্রযুক্তি গ্রহণ ও পরিবেশ মান রক্ষা—এসব খাতে সূচকের মান কমেছে।
তবে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা পরিবেশ সূচক দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট। মাত্র ০.৯৪ পয়েন্ট বৃদ্ধি বিশেষ কোনো উন্নয়ন হিসেবে দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি এবং মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা—এসব কারণ ব্যবসার পরিবেশকে চাপে ফেলেছে।
দেশের ১২টি খাতকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়—খুচরা ও পাইকারি বাণিজ্য, পরিবহন, নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া, কৃষি, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ, তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও আর্থিক খাত।
বিবিএক্সে ১১টি মূল সূচক ধরা হয়েছে—ব্যবসা শুরু, ভূমি প্রাপ্তি, নিয়ন্ত্রক তথ্য, অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর প্রদান, প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থায়ন ও পরিবেশ বিধিমালা।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মসরুর রিয়াজ বলেন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে এখনই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তিনি জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের ব্যবসার ৫৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ দুই শহরে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। নতুন ব্যবসা শুরু করাও সেখানে বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, সিলেট ১১টির মধ্যে ৪টি সূচকে এবং বরিশাল ৩টি সূচকে শীর্ষে রয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাইকারি বাণিজ্যে এর প্রভাব বেশি। ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে ভুগছে এবং ৬০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সমস্যায় পড়েছে।
ড. রিয়াজ বলেন, “সরকারি কর্মকর্তারা অনেক সময় সমস্যা স্বীকার করেন, কিন্তু দ্রুত সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিবিএক্সের তথ্য সরকারকে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে।
প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট
এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি. রহমান বলেন, বিবিএক্স বাংলাদেশের বাস্তব অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে। এটি নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স। তিনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটালাইজেশন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি—এসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখন বড় বাধা। অনেক কর্মকর্তা দায়িত্বহীনভাবে কাজ করছেন, যা ব্যবসা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়।”
বার্জার পেইন্টসের এমডি রূপালি চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদেরও আইন মেনে চলতে হবে। “অনেক প্রতিষ্ঠান বারবার লোকসান দেখিয়ে ন্যূনতম কর পরিহার করতে চায়, তাই স্বচ্ছতা ও অটোমেশন জরুরি,” বলেন তিনি।
প্রধান অতিথি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ব্যাংক সুদের উচ্চ হার ব্যবসার জন্য বড় বাধা। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী বছরের শুরুতেই ঋণের সুদহার কিছুটা কমবে।
তিনি আরও বলেন, “দুর্নীতি ব্যবসার পরিবেশের জন্য বড় প্রতিবন্ধক। তবে শক্ত নজরদারি ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে এটি কমানো সম্ভব।”
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি আহ্বান জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোনো দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সরাসরি জানাতে, এবং আশ্বাস দেন যে সরকার সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

