বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় উড়োজাহাজের টিকিট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ খসড়া করেছে। এটি ‘বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ২০১৭ সংশোধন করে প্রস্তুত করা হয়েছে।
খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যদি যাত্রী থেকে টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে, তবে তাকে সেই অতিরিক্ত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া, যদি কোনো এজেন্সি টিকিট মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বা অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে, তাহলে সেই অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
নতুন খসড়া অধ্যাদেশ প্রয়োগে বিমান যাত্রীদের অধিকার সুরক্ষা এবং টিকিটের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মন্ত্রণালয় আশা করছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় উড়োজাহাজের টিকিট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ‘বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ খসড়া করেছে। খসড়া অধ্যাদেশে বিভিন্ন প্রকার ফি, চার্জ ও ভাড়া নির্ধারণের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া খসড়া অনুযায়ী, কোনো গ্রাউন্ড অপারেটর নিবন্ধিত না হলে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান বলেন, “বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যায়ে খসড়ার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলব না।” সম্প্রতি উড়োজাহাজের টিকিট নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। টিকিট সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়েছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকরা সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অসাধু এজেন্সি ও কিছু এয়ারলাইন্স কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত চক্রের কারণে যাত্রীদের কয়েকগুণ বেশি টিকিট কিনতে হচ্ছে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিকিট সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সিন্ডিকেটে জড়িত অনেক ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। তবে ২০১৭ সালের আইনে টিকিট সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য বিশেষ কোনো শাস্তির বিধান ছিল না। তাই আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর এটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ খসড়ায় উড়োজাহাজের টিকিট সংক্রান্ত কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন আইনে দুটি ধারা (৩৪-ক ও ৩৪-খ) যুক্ত হচ্ছে। খসড়া অনুযায়ী, কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যদি যাত্রী থেকে ট্যারিফের অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে, তবে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য ওই ট্রাভেল এজেন্সিকে অতিরিক্ত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া, কেউ যদি টিকিট মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে, তাহলে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ট্যারিফ দাখিল ও অনুমোদনের বিষয়ে বলা হয়েছে, এয়ার অপারেটররা তাদের সব রুটের সব শ্রেণির ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ ট্যারিফ নিয়মিতভাবে বেবিচকের চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করবে। চেয়ারম্যান সন্তুষ্ট হলে তা অনুমোদন করবেন। কোনো রুটে একচেটিয়া কারবার, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বা কৃত্রিম সংকট দেখা দিলে চেয়ারম্যান জনস্বার্থে যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণে ব্যবস্থা নেবেন।
নতুন খসড়ায় ‘বিমান চলাচল ও পরিবেশ সুরক্ষা’ সম্পর্কিত ধারায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক লক্ষ্য অনুসারে বিমান চলাচলের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে টেকসই বিমান জ্বালানির ব্যবহার ও উন্নয়নে সরকার নীতি প্রণয়ন করতে পারবে এবং প্রয়োজনে প্রণোদনা দিতে পারবে। এর পাশাপাশি বেসামরিক বিমান চলাচল অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কমিশন কর্তৃপক্ষ ও গ্রাউন্ড অপারেটরের ধার্যকৃত ফি, চার্জ, রয়্যালটি, প্রিমিয়াম ও ভাড়া নির্ধারণে তত্ত্বাবধান করবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ খসড়ায় বেসামরিক বিমান চলাচল অর্থনৈতিক কমিশন স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ফি, চার্জ, রয়্যালটি, প্রিমিয়াম ও ভাড়া সুপারিশ করার ক্ষমতা পাবে। কমিশন বিমানবন্দরের অবস্থান, বিমানের প্রকৃতি ও এয়ার অপারেটরের ধরন বিবেচনা করে এক বা একাধিক প্রকার ফি সুপারিশ করতে পারবে। তবে সরকারের জন্য এই সুপারিশ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে না।
সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃপক্ষ ও গ্রাউন্ড অপারেটরের জন্য ফি, চার্জ, রয়্যালটি, প্রিমিয়াম ও ভাড়া নির্ধারণ করবে। এই তথ্য ২০১৭ সালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী চেয়ারম্যান তফসিলে প্রকাশ করা হবে। কমিশন এয়ার অপারেটর ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে এই ফি, চার্জ, রয়্যালটি ও ভাড়া নিয়ে বিরোধ থাকলে বিধি অনুযায়ী তা সমাধান করতে পারবে।
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকার বিদেশি অপারেটরের সাধারণ বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ, গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ব্যবহার, বিমান চলাচল ও পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত নীতি এবং বেসামরিক বিমান চলাচল অর্থনৈতিক কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবে। বর্তমান আইনে বিদেশি এয়ার অপারেটরকে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে হলে বাংলাদেশি নাগরিকের ১০০% মালিকানাধীন নিবন্ধিত সংস্থাকে একক বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করতে হয়। নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদেশি এয়ার অপারেটর বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন সেবা দিতে চাইলে দুইভাবে করতে পারবে:
-
বাংলাদেশে নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন, বা
-
বাংলাদেশি নাগরিকের ১০০% মালিকানাধীন ও নিবন্ধিত এক বা একাধিক সংস্থাকে সাধারণ বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ।
সাধারণ বিক্রয় প্রতিনিধি প্রয়োজন মনে করলে দেশি এয়ার অপারেটরও তা নিয়োগ করতে পারবে। সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো গ্রাউন্ড অপারেটর নিবন্ধিত না হলে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। গ্রাউন্ড অপারেটরকে নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে। নিয়ম মেনে আবেদন করলে চেয়ারম্যান নিবন্ধন সনদ দেবেন।
কোনো গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম নিবন্ধিত না হলে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম কে নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। চেয়ারম্যান নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত পদ্ধতিতে গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম এ সংরক্ষিত বুকিং ও মূল্য-সম্পর্কিত ডেটা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও তাৎক্ষণিকভাবে প্রবেশ করার ক্ষমতা পাবেন।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যদি কোনো নিবন্ধিত গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম-এর বিরুদ্ধে জনস্বার্থের পরিপন্থি অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে চেয়ারম্যান বুকিং অক্ষুণ্ণ রেখে সেই গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম-এর নিবন্ধন সাময়িকভাবে স্থগিত বা বাতিল করতে পারবেন।

