সরকার ব্যবসার পরিবেশ সহজ ও গতিশীল করতে বিনিয়োগসংক্রান্ত ছয়টি সংস্থাকে একীভূত করে একটি কেন্দ্রীয় ‘ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন এজেন্সি (আইপিএ)’ গঠন করতে যাচ্ছে। এই নতুন সংস্থা বিনিয়োগকারীদের জন্য একক সমাধান কেন্দ্র বা ওয়ান-স্টপ সলিউশন হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই একীভূতকরণের উদ্যোগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।
এই উদ্যোগ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত ভিন্ন। কেউ বলছেন, এটি বিনিয়োগের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। আবার কেউ মনে করেন, বিশেষভাবে বেপজাকে এর আওতায় আনা ঠিক হবে না। চীনা বিনিয়োগকারীরাও ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মনে করেন, সংস্থা একীভূত হোক বা না হোক, ব্যবসা সংক্রান্ত সনদ প্রদানের প্রক্রিয়া পুরোপুরি ডিজিটাল করা জরুরি।
২০১৬ সালে বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনকে একীভূত করে বিডা গঠন করা হয়েছিল। বিনিয়োগকে গতিশীল করার লক্ষ্য থাকলেও উদ্যোক্তারা এখনও নানা অভিযোগ জানাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ছয়টি সংস্থা এক ছাতার নিচে আনলেও এটি কতটা বিনিয়োগবান্ধব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনার নির্দেশনা দেন। এসব সংস্থা হলো– বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ), পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ) এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
বিডার নির্বাহী সদস্য ও হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান রচি বলেন, আইপিএ গঠনের জন্য চলতি মাসেই আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সিঙ্গাপুরের তিন প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। আবেদনগুলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে এবং এরপর নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে।
তিনি জানান, সংস্থাগুলোকে কীভাবে একীভূত করা হবে, তা নির্ধারণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে পথনকশা দেবে। মূল কাজ শুরু হবে এরপরই। ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও মোটামুটি বাস্তবায়নযোগ্য করা হবে যাতে পরবর্তী সরকার সহজে তা বাস্তবায়ন করতে পারে।
ব্যবসা সহজ এবং বিনিয়োগকারীর হয়রানি কমানোর জন্য আইপিএ গঠন করা হচ্ছে। নাহিয়ান রহমান রচি বলেন, পাঁচটি নীতির ওপর ভিত্তি করে আইপিএ গঠন করা হবে। এতে কোনো সংস্থার চাকরিজীবীর সমস্যা হবে না এবং কোনো সংস্থার বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে না।
কেন বিনিয়োগ সংস্থাগুলো একীভূত করা হচ্ছে:
শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ দেয় বিভিন্ন সংস্থা—বেজা, বেপজা, বিসিক, হাইটেক পার্ক এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষ। বিনিয়োগকারীদের এসব সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ করতে হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হন। কোন সংস্থা থেকে প্লট নিলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে, কোথায় কোন ধরনের সুবিধা মিলবে—এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে তারা সময় ও শ্রম খরচ করেন।
বিডা বলছে, বিনিয়োগ সংস্থাগুলো আলাদাভাবে কাজ করার কারণে সার্বিক বিনিয়োগ কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। তাই ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করতে একটি বড় সংস্থা গঠন করা হচ্ছে। নতুন সংস্থাটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একক সমাধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
বিডা ও বেজার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে ছয়টি সংস্থার একীভূতকরণ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কিনা, তা অনিশ্চয়। কারণ সরকারের কার্যক্রম এখন অনেকটাই নির্বাচনমুখী। তারা মনে করেন, একীভূত করার আগে বিস্তারিত পর্যালোচনা দরকার। বিশেষত বিনিয়োগকারীদের মতামত নেওয়া জরুরি। অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন।
একই সময়ে, বেপজার কর্মকর্তাদের মধ্যে একীভূতকরণের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। যদিও সরকারকে লিখিত অবস্থান জানানো হয়েছে কিনা নিশ্চিত নয়। তবে বেপজার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বেপজা মূলত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ। তারা রপ্তানিকারকদের নির্বিঘ্নে সেবা দিচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হলে বিনিয়োগকারীদের জন্য জটিলতা তৈরি হতে পারে। বেপজার অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেপজার এক কর্মকর্তা জানান, একীভূতকরণের বিষয়ে চীনা বিনিয়োগকারীরা আপত্তি জানিয়েছে। তারা মনে করেন, একীভূত হওয়ার চেয়ে কাস্টমস-বন্দরের সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেওয়াই জরুরি।
একীভূতকরণ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় বেপজাকে অন্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত না করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইপিজেড ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এবং শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ। তিনি বলেন, অন্যান্য সংস্থার চেয়ে বেপজার অধীন ইপিজেডগুলো ভালো কাজ করছে। ৪০ থেকে ৪৫ বছর ধরে সেবা দেওয়া বেপজার নিয়মকানুনে ঝামেলা কম। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর আগ্রহ বেশি। সেখানে একটি দক্ষ ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে। শামস মাহমুদ মনে করেন, বেপজাকে অন্য সংস্থার সঙ্গে একীভূত করা ঠিক হবে না। যারা ভালো সেবা দিতে পারছে না, কেবল তাদেরকেই একীভূত করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের কোনো সমস্যা হলে বেপজা তাৎক্ষণিক সমাধান করে। অন্য সংস্থার ক্ষেত্রে এটি কল্পনাও করা যায় না। একীভূত হলে বেপজার বিনিয়োগকারীর জন্য নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, সরকারি উদ্যোগটি ইতিবাচক। তবে একীভূত করা এবং বিনিয়োগকারীদের সেবা নিশ্চিত করা দুটি ভিন্ন বিষয়। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এখনও এক শতাংশেরও কম। দেশের বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, ব্যবসা সহজ করার ধাপগুলোতে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। ব্যবসা শুরু করতে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের থেকে সনদ নিতে হয়। এটি বেশ জটিল প্রক্রিয়া। তাই একীভূতকরণের পাশাপাশি সনদ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া পুরোপুরি ডিজিটাল করা জরুরি।

