দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। এখন বছরে দেড় কোটি টনের বেশি ফল উৎপাদন হচ্ছে। এক যুগ আগে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি টনের কাছাকাছি। বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়ায় টেকসই ও ধারাবাহিক কৃষি প্রবৃদ্ধি এসেছে। এই সময়ে আম, জাম, লিচু, কলা ও আনারসের উৎপাদন বেড়েছে। তবে কাঁঠাল ও নারিকেলের উৎপাদন কমেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে এক কোটি ৫০ লাখ ৩৩ হাজার টন ফল উৎপাদন হয়েছে। এসব ফল চাষ হয়েছে ৭ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫৯ হেক্টর জমিতে। তথ্য অনুযায়ী, ঠিক এক যুগ আগে অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ফলের উৎপাদন ছিল ৯৯ লাখ ৭২ হাজার টন। ওই সময় ফল চাষের জমি ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৪৫ হেক্টর।
এরপর ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন, ২০১৫-১৬ সালে ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০১৬-১৭ সালে ১ কোটি ২০ লাখ টন। পরের দুই বছর ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ২১ লাখ টনের ঘরে। এরপরের বছরগুলোতে যথাক্রমে ১ কোটি ২৩ লাখ, ১ কোটি ২২ লাখ, ১ কোটি ৪৩ লাখ ও ১ কোটি ৫০ লাখ টন ফল উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে ফলের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার টন। চাষের জমি ছিল ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯৬ হেক্টর। ফলে বলা যায়, দেশ এখন ফল উৎপাদনে স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি লক্ষ্য করছে।
আম, জাম, লিচু, কলা ও আনারসের বেড়েছে উৎপাদন:
দেশে ফলের উৎপাদন বেড়ে ৫০ লাখ টনের বেশি হয়েছে। বিশেষ করে আম, জাম, লিচু, কলা ও আনারসের উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কাঁঠাল এখনও মানুষের কাছে তেমন জনপ্রিয় নয়। উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মইনুল হক বলেন, কাঁঠাল বাণিজ্যিকভাবে আম বা লিচুর মতো চাষ করা হয়নি। এ কারণে এর উৎপাদন কম রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের প্রধান দশটি ফলের মধ্যে আম, জাম, লিচু, কলা, বরই, পেঁপে, পেয়ারা ও আনারসের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৪-২৫ সালের আলাদা ফলের উৎপাদনের তথ্য এখনো হালনাগাদ হয়নি, তাই সর্বশেষ পাওয়া তথ্য ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত। এক যুগে (২০১২-১৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর) আমের উৎপাদন ১৫ লাখ ৪ হাজার টন থেকে বেড়ে ২৫ লাখ ০৮ হাজার টনে পৌঁছেছে। চাষের জমিও ১ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার হেক্টর।
জামের উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ হাজার টন থেকে ৪৫ হাজার টনে, লিচু বেড়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টনে। কলার উৎপাদন ১৫ লাখ ১ হাজার থেকে ২৪ লাখ ৩৮ হাজার টনে, পেঁপে বেড়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার টনে। পেয়ারা ৩ লাখ ১৪ হাজার থেকে ৬ লাখ ১৩ হাজার টনে, বরই বেড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৬ হাজার টনে। আনারসের উৎপাদন সর্বাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার টনে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ফল উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাণিজ্যিক চাষাবাদ, নতুন প্রযুক্তি ও বৈচিত্র্যময় ফলের চাষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আম, কলা ও আনারসের মতো ফলের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকায় আগামীতে আরও বেশি ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন আশা করা যাচ্ছে।
কমেছে কাঁঠাল ও নারিকেলের উৎপাদন:
গত এক যুগে দেশের প্রধান ফলের মধ্যে কাঁঠাল ও নারিকেলের উৎপাদন কমেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কাঁঠালের উৎপাদন ছিল ৩২ লাখ ১২ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি কমে হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টনে। একই সময়ে কাঁঠাল চাষের জমিও কমেছে ৮২ হাজার ৬৯১ হেক্টর থেকে ৫৮ হাজার ৭০০ হেক্টরে। নারিকেলের উৎপাদনও কমেছে। এক যুগ আগে ৫ লাখ ৯১ হাজার টন থেকে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫ হাজার টনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভূ-প্রকৃতি কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য অনুকূল হলেও বাণিজ্যিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে আমরা পিছিয়ে। কাঁঠালের ব্যবহার বহুমুখী না হওয়ায় দামও কম। ফলে কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মইনুল হক বলেন, “অন্য ফলের উৎপাদন বাড়লেও কাঁঠাল খাওয়ার বিষয়ে মানুষের অনীহা রয়েছে। আম বা লিচুর মতো বাণিজ্যিক চাষাবাদ হয়নি এ ফলের। এ কারণে উৎপাদন কমছে।”
বিদেশি ফলের চাষ বাড়ছে:
দেশে শুধু দেশি ফল নয়, ড্রাগন, স্ট্রবেরি ও মাল্টা জাতীয় বিদেশি ফলের উৎপাদনও দ্রুত বেড়ে চলেছে। এসব ফল এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১-২২ সালে ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ করা হয়। সেই বছর উৎপাদন ছিল ১৩ হাজার ৮৭২ টন। পরের বছর ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন বেড়ে ৫১ হাজার ২৮৭ টনে পৌঁছায়, চাষের জমিও ২ হাজার ৫৮৮ হেক্টর। ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৮১৩ টনে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ফল আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা কমছে। আমদানিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম হয়েছে।” উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মইনুল হক জানান, “থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাত নিয়ে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষ শুরু হয়। এখন এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। ফলের স্বাদ মাঝারি মিষ্টি এবং উৎপাদনও ভালো।”
শীতপ্রধান দেশের ফল স্ট্রবেরির বাণিজ্যিক চাষ বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৭ সালে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এটি উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে দেশে জায়গা করে নিয়েছে। দেশে দেশি মাল্টার চাষও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাল্টার উৎপাদন ছিল ১৭ হাজার টন। ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে ৮৪ হাজার টন ছাড়িয়েছে। একই সময়ে মাল্টার বাগানের পরিমাণ ২ হাজার ৪৩৩ হেক্টর থেকে প্রায় ৮ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে মাল্টার চাষ বেশি। বান্দরবান শীর্ষে, এরপর খাগড়াছড়ি, তৃতীয় অবস্থানে রাজশাহী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি ফলের বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশি চাষিদের নতুন আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা কমছে। ড্রাগন, মাল্টা, স্ট্রবেরি ছাড়াও রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, কাঠলিচু, সাম্মামের মতো উচ্চমূল্যের বিদেশি ফল এখন দেশে চাষ হচ্ছে। উদ্যানতত্ত্ব শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো, আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং লাভজনক হওয়ার কারণে কৃষকরা বিদেশি ফল চাষে উৎসাহী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ফলের মোট উৎপাদন ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২২ টন থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৭ টনে। এক বছরে উৎপাদন ২১ হাজার টনেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে বিদেশি ফল চাষের জমি ১৫ হাজার ৪৩১ হেক্টর থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ৫৬৮ হেক্টর হয়েছে। দেশে উৎপাদনের পাশাপাশি চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ৩৮ ধরনের বিদেশি ফল আমদানি করা হয়। এনবিআরের তথ্যানুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানিতে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল:
- আপেল: ১ লাখ ৭০ হাজার টন
- কমলা: ১ লাখ ৯৪ হাজার টন
- আঙুর: ৯৫ হাজার ১৩০ টন
- আম: ৭৫ টন
- বেদানা: ৬ হাজার ৯৩ টন
- মাল্টা: ৬০ হাজার ৫৩৮ টন
- কেনু: ২১ হাজার ৫৮৫ টন
- ড্রাগন: ৪৯০ টন
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, “ফল আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা কমছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমানে আমদানিও অনেক কম হয়েছে।” বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বিদেশি ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি হ্রাস কৃষকদের নতুন আয়ের সুযোগ তৈরি করছে। একই সঙ্গে বাজারে চাহিদা মেটানো সহজ হচ্ছে।
নতুন নীতি-সহায়তা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে ফল উৎপাদন:
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প দেশে ফলের উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চলতি বছর এই প্রকল্প শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের সবশেষ পরিচালক আব্দুল হালিম জানান, ওই প্রকল্পের আদলে আরও একটি নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। তিনি বলেন, “ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগের সরকারের উদ্যোগে দেশি ফলের উৎপাদন বাড়ায় বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা অনেক কমেছে।”
তিনি আরও জানান, “মানুষের দেশি ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে দেশি ও বিদেশি ফল চাষাবাদে। ফলের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রক্রিয়াকরণেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকার উৎপাদন বাড়াতে ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আরও নীতি-সহায়তা গ্রহণের কাজ করছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি প্রকল্প ও নীতি-সহায়তার কারণে দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং ফলের বাজার আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

