চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় আজ সোমবার বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ডেনমার্কের মালিকানাধীন এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হওয়ার কথা। সকালে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে। দ্রুতগতিতে এ চুক্তি চূড়ান্ত করার কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
একই দিন বিকেলে একই স্থানে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল নিয়েও আরেকটি চুক্তি হবে। ২২ বছর মেয়াদে পানগাঁও টার্মিনালের পরিচালনা দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএকে। আর লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পাবে এপিএম টার্মিনালস। মেয়াদ ৩৩ বছর। চুক্তিতে আরও ১৫ বছর বাড়ানোর সুযোগও থাকছে। যদিও কোম্পানিটি ডেনমার্কের মালিকানাধীন, এর নিবন্ধন নেদারল্যান্ডসে।
অস্বাভাবিক দ্রুততায় চুক্তির প্রক্রিয়া:
লালদিয়া প্রকল্পে বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, টার্মিনাল অপারেটরের প্রস্তাব জমা থেকে চুক্তি সম্পন্ন করতে ৬২ দিন সময় লাগবে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ মাত্র দুই সপ্তাহে পুরো কার্যক্রম শেষ করেছে। এতে স্বচ্ছতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সে সময় কোনো তাড়াহুড়া ছিল না। প্রক্রিয়া চলছিল স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু ৪ নভেম্বর এপিএম টার্মিনালস তাদের প্রস্তাব জমা দেওয়ার পরই হঠাৎ দ্রুতগতিতে সব কাজ এগিয়ে যায়।
লালদিয়া চুক্তির ধাপগুলো:
- ৪ নভেম্বর: এপিএম টার্মিনালসের প্রস্তাব দাখিল
- ৫ নভেম্বর: কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন
- ৬ নভেম্বর: আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন
- ৯ নভেম্বর: বন্দর ও এপিএম টার্মিনালসের নেগোসিয়েশন
- অভিযোগ রয়েছে, ৭–৮ নভেম্বর ছুটির দিনেও নেগোসিয়েশন হয়
- ৯ নভেম্বর: বন্দর বোর্ড সভায় অনুমোদন
- ১০–১১ নভেম্বর: নৌপরিবহন ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন
- ১২ নভেম্বর: অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ
- ১৬ নভেম্বর: প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদন
- ১৬ নভেম্বর: চিঠি (লেটার অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যু
- ১৭ নভেম্বর: চুক্তির দিন
পানগাঁও নৌ টার্মিনাল চুক্তির ধাপ:
- ৬ নভেম্বর: কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন
- ৯ নভেম্বর: আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন
- ১০ নভেম্বর: বন্দর থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো
- ১৭ নভেম্বর: চুক্তির দিন
যেভাবে অস্বাভাবিক দ্রুততায় চুক্তি:
জানা গেছে, ৪ নভেম্বর এপিএম টার্মিনালস কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়। পরদিন ৫ নভেম্বর প্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন করা হয়। আর ৬ নভেম্বর আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের পরই দর–কষাকষি শুরু হয়। বন্দর সূত্রের তথ্য, সরকারি ছুটির দিন ৭ ও ৮ নভেম্বর শুক্র ও শনিবারই দর–কষাকষি শেষ করা হয়। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, দর–কষাকষি শেষ হয়েছে ৯ নভেম্বর।
এদিনই বন্দরের বোর্ড সভায় প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। অনুমোদনের পর সারসংক্ষেপ একই দিনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরের দিন তা যায় আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর ১২ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় প্রস্তাবটি তোলা হলে তারা অনুমোদনের সুপারিশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশের পর গতকাল রবিবার প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। একই দিনে এপিএম টার্মিনালসের কাছে চুক্তির জন্য ‘লেটার অব অ্যাওয়ার্ড’ পাঠানো হয়। সাধারণত লেটার অব অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর চুক্তি সম্পন্ন করতে দুই সপ্তাহ সময় রাখা হয়। কিন্তু এবার এক দিনেরও কম সময়ে চুক্তি হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
পানগাঁও চুক্তিও দ্রুত হচ্ছে:
লালদিয়ার মতোই দ্রুত সময়ে এগোচ্ছে পানগাঁও নৌ টার্মিনালের চুক্তির প্রক্রিয়া। ৬ নভেম্বর টার্মিনালের কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ৯ নভেম্বর আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন করা হয়। পরদিন তা অনুমোদনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গতকাল পর্যন্ত দরপত্রের সব ধাপ শেষ করা হয়েছে। অর্থাৎ কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের মাত্র এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া শেষ করে চুক্তিতে যাওয়া হচ্ছে।
এই টার্মিনাল পরিচালনার জন্য মেডলগ এসএ প্রথমে ১০৮ কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়। পরে দর–কষাকষিতে তা প্রায় ১২১ কোটি টাকায় চূড়ান্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে ২০১৩ সালে ১৫৬ কোটি টাকায় এই টার্মিনাল নির্মাণ করে।
তাড়াহুড়ায় সন্দেহ:
লালদিয়ার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অনেক তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারণ, এতে ‘নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ রয়েছে। কোন অংশ প্রকাশ করা হবে, আর কোন অংশ নয়—তা জানা যাবে চুক্তির দিন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গোপনীয়তা আর তাড়াহুড়া করে এমন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি। জনগণের প্রতি গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব নেওয়া সরকারের এই আচরণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলার মতো জরুরি বিষয় বাদ দিয়ে বন্দর নিয়ে সরকারের এমন তাড়াহুড়া সন্দেহ তৈরি করে। এতে বোঝা যায়, বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা কমিশনভোগীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
তবে নৌপরিবহন উপদেষ্টা গত সপ্তাহে বন্দর পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, দেশের ক্ষতি করে কাউকে টার্মিনাল দেওয়া হবে না। চুক্তির পর পুরো বিষয় জানা যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

