এশিয়া এখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম কেন্দ্র। বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক শক্তির বেশির ভাগই এ অঞ্চলে সক্রিয়। ফলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমও এশিয়ার ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের দিকে আগের চেয়ে বেশি নজর দিচ্ছে। নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও র্যাংকিং। এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ফোর্বস ম্যাগাজিনও সময়-সময় এশিয়ার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
ফোর্বসের সর্বশেষ তালিকা ‘এশিয়ার ২০ শক্তিশালী নারী ব্যবসায়ী’। নভেম্বর মাসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে প্রথম স্থানে রয়েছেন ফিলিপাইনের মাইবেল ভি. আরাগন-গোবিও। দ্বিতীয় স্থানে মালয়েশিয়ার সারিনা চিয়াহ এবং তৃতীয় স্থানে দক্ষিণ কোরিয়ার চুং ইউ-ক্যাং। এই তালিকায় সর্বোচ্চ তিনজন করে আছেন ভারত ও হংকং থেকে। ফিলিপাইন, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও চীন থেকে স্থান পেয়েছেন দুজন করে। আর মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান থেকে একজন করে নারী ব্যবসায়ী জায়গা পেয়েছেন।
এশিয়ার ডজনখানেক দেশের এই নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডেটা সেন্টার, সেমিকন্ডাক্টর, বিরল খনিজসহ প্রযুক্তিনির্ভর খাতে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও উন্নত প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। অনেকেই পারিবারিক ব্যবসাকে আধুনিক রূপ দিয়ে নতুন উচ্চতায় তুলেছেন। সম্পদ ব্যবস্থাপনা, আতিথেয়তা, খুচরা বিক্রি ও ক্রীড়া সরঞ্জাম খাতেও তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। এই ২০ জনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পেশাদার ব্যবস্থাপক। ব্যাংকিং, ভোক্তা পণ্য ও পরিবহন খাতে তাঁদের দক্ষতা স্বীকৃত। তালিকায় আছেন তিনজন প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা। একজন ইতিমধ্যে দুটি লাভজনক ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকও। ফোর্বসের তালিকার শীর্ষ পাঁচ নারী কারা এবং কোন খাতে তাঁরা কাজ করছেন—তা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

১. মাইবেল ভি. আরাগন-গোবিও, বয়স: ৫২, দেশ: ফিলিপাইন:
এ বছর দেশের করপোরেট জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রবিনসন্স ল্যান্ড তাঁকে প্রেসিডেন্ট ও সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয়। জে জি সামিটের অধীন সম্পত্তি ব্যবসার এই প্রতিষ্ঠানটি ফিলিপাইনের অন্যতম বৃহৎ সংস্থা। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আসীন হলেন।
আরাগন-গোবিওর দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে। ধীরে ধীরে তিনি প্রতিষ্ঠানের লজিস্টিকস ব্যবসা এবং আবাসিক ও অফিস প্রকল্পের নেতৃত্বে আসেন। তিন দশকের অভিজ্ঞতা তাঁকে শীর্ষ পদে পৌঁছে দেয়। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পর, গত মে মাসে, তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বিস্তৃত ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। লক্ষ্য—আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোম্পানির ব্যবসা ২২০ কোটি ডলারে উন্নীত করা। একই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে নিট আয় দ্বিগুণ করার রোডম্যাপও তুলে ধরেন।
তাঁর পরিকল্পনায় রয়েছে বিপণিবিতানের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬৯-এ উন্নীত করা, অফিস স্পেস ৫০ শতাংশ বাড়ানো এবং হোটেলকক্ষ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০-এ নিয়ে যাওয়া। লজিস্টিকস সক্ষমতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যও তাঁর কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। এই বিস্তৃত পরিকল্পনা মাইবেল আরাগন-গোবিওকে শুধু রবিনসন্স ল্যান্ডের প্রথম নারী নেতা হিসেবে নয়, বরং ফিলিপাইনের করপোরেট জগতে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির অন্যতম স্থপতি হিসেবে তুলে ধরেছে।

২. সারিনা চিয়াহ, বয়স ৫০, মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ার সারিনা চিয়াহ এ বছর সানওয়ে গ্রুপে নতুন দায়িত্ব নিয়ে আলোচনায় আসেন। জানুয়ারি মাসে তাঁকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী উপ–চেয়ারম্যান করা হয়। সানওয়ে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, আর তিনি এর সঙ্গে যুক্ত আছেন তিন দশকেরও বেশি সময়। আবাসন থেকে স্বাস্থ্যসেবা—বিভিন্ন খাতে তাঁর ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই সময় তিনি কোম্পানির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্প্রসারণ প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরই কোম্পানির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে সানওয়ে ৫৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারে এমসিএল ল্যান্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে। এটি সানওয়ের বৈশ্বিক সম্প্রসারণ কৌশলে বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

৩. চুং ইউ-ক্যাং, বয়স: ৫৩, দেশ: দক্ষিণ কোরিয়া:
দক্ষিণ কোরিয়ার চুং ইউ-ক্যাং গত বছর শিনসেগে ইনকরপোরেশনের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নেন। এটি তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্ব নেওয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল কোম্পানির উচ্চ প্রবৃদ্ধি পুনরায় ফিরিয়ে আনা। চুং ইউ-ক্যাং দায়িত্ব নেওয়ার পর আমদানি করা সৌন্দর্য পণ্য থেকে সরিয়ে স্থানীয় পণ্যে জোর দিতে শুরু করেন। সিউল শহরের উচ্চবিত্ত এলাকায় বিশেষভাবে স্থানীয় ব্র্যান্ডের সৌন্দর্য পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে কোম্পানিতে নতুন গতি এসেছে এবং ব্যবসার ফলাফল ইতিবাচক হচ্ছে।

৪. লানি দার্মাওয়ান, বয়স-৬৩, দেশ: ইন্দোনেশিয়া:
ইন্দোনেশিয়ার লানি দার্মাওয়ান চার বছর আগে ব্যাংক সিআইএমবির প্রেসিডেন্ট ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন। এটি দেশটির সপ্তম বৃহত্তম ব্যাংক। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ব্যাংককে ধারাবাহিকভাবে চারবার রেকর্ড নিট মুনাফা অর্জন করতে সাহায্য করেছেন। ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিও পুনর্বিন্যস্ত করে ক্ষুদ্র ও মধ্যম ব্যবসা এবং উচ্চ মার্জিনের রিটেইল ঋণের অংশ ৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছেন। তার নেতৃত্বে ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়েছে, যা বাজারের গড় বৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। লানি দার্মাওয়ান ইন্দোনেশিয়ায় সিআইএমবি গ্রুপের প্রথম নারীপ্রধান হিসেবে ইতিহাস রচনা করেছেন।

৫. এমিলি হং, বয়স: ৬৮, দেশ: তাইওয়ান:
৬৬ বছর বয়সী এমিলি হং তাইপেভিত্তিক উইওয়াইন কোম্পানির চেয়ার ও প্রধান কৌশল কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উইওয়াইন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্ভার সেবা দিয়ে অগ্রণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এমিলিই ২০১২ সালে উইস্ট্রনের সাবসিডিয়ারি হিসেবে উইওয়াইন প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তি খাতে ক্লাউড অবকাঠামোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা। তার নেতৃত্বে কোম্পানির উত্থান ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রাজস্ব ১৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কর–পরবর্তী মুনাফা বেড়ে যায় ১৩৩ শতাংশ। শেয়ারের মূল্য ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বাজার মূলধনও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এমিলি কোম্পানির প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক সাফল্যের মূল স্থপতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এই তালিকায় আরও আছেন বিভিন্ন এশীয় ও অস্ট্রেলিয়ান দেশ থেকে ২০ জন প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে রয়েছেন:
- থাইল্যান্ড: ৬০ বছর বয়সী ক্যাটিয়া ইন্দরবিজয়া
- ভারত: ৪২ বছর বয়সী রুচি কালরা, ৩৬ বছর বয়সী মাসি কিরলোসকার টাটা, ৫৩ বছর বয়সী প্রিয়া নায়ার
- তাইওয়ান: ৭৪ বছর বয়সী মার্গারেট কাও
- সিঙ্গাপুর: ৬১ বছর বয়সী জেমি খো, ৫০ বছর বয়সী পিএনজি চিন ই
- হংকং: ৪৮ বছর বয়সী কুওক হুই কুওয়ং, ৫৪ বছর বয়সী ম্যাগি এনজি, ৬০ বছর বয়সী জেনি ইয়ুং
- চীন: ৫৭ বছর বয়সী জেইন সান, ৬৫ বছর বয়সী জৌ চাওনান
- জাপান: ৩৮ বছর বয়সী অ্যালিসা ইয়োনইয়ামা
- ফিলিপাইন: মারিয়ানা জোবেল দে আয়ালা
তাদের সক্রিয়তা ডেটা সেন্টার, সেমিকন্ডাক্টর, ক্লাউড সার্ভিস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, ভোক্তা পণ্য ও বিভিন্ন খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। এই নারীরা এশিয়ার অর্থনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করছেন এবং প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের পথ তৈরি করছেন।

