ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছিল। ভোট ছাড়াই সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর এই সংগঠনগুলোর পদ ধরে রাখতেন।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও ভোটের মাধ্যমে অধিকাংশ সংগঠনের নেতৃত্ব প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হাতে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতৃত্বের অভাবে সংগঠনগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এতে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
নেতৃবিহীনতার পেছনে বড় কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী নেতারা নতুন বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় ত্রুটি ও বিচ্যুতি উল্লেখ করেছেন। ব্যবসায়ীদের আপত্তির পর এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজটি খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কয়েকটি চেম্বার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যেকার বিভাজন ও পাল্টাপাল্টি মামলাও পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এফবিসিসিআইয়ের পর অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনের কিছু সদস্যও প্রশাসক নিয়োগের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তদবির শুরু করেন।
এর প্রেক্ষিতে একে একে প্রশাসক নিয়োগ করা হয় চট্টগ্রাম চেম্বার, সিলেট চেম্বার, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ই-ক্যাব), তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, সফটওয়্যার শিল্পের সংগঠন বেসিস, সিলেট উইমেন চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব), বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এসিড ব্যবসায়ী সমিতি, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স (বিসিসিসিআই) ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন।
এর মধ্যে সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও এসিড ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা প্রশাসক নিয়োগ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং নিজেদের পক্ষে রায় পান। জানা গেছে, প্রশাসক নিয়োগ হওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বিজিএমইএ, সিলেট উইমেন চেম্বার ও বাংলাদেশ চায়না চেম্বারের নির্বাচন হয়েছে। বিজিএমইএ ও সিলেট উইমেন চেম্বারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলেও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে এফবিসিসিআই, সিলেট ও চট্টগ্রাম চেম্বার এবং ই-ক্যাবের নির্বাচনের তফসিল থাকলেও নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। এক বছরের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ায় এফবিসিসিআই ও ই-ক্যাবে নতুন প্রশাসকও নিয়োগ দিতে হয়েছে মন্ত্রণালয়কে।
নির্বাচন না হওয়ায় ফেডারেশন কার্যহীন:
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ও সহসভাপতি সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে নির্বাচিত হতেন। যারা সমর্থন পেতেন, শুধু তারাই পদে মনোনয়ন পেতেন। সাধারণ সদস্যদের ভোটের কোনো প্রয়োজন হতো না। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা এফবিসিসিআই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই দাবি আরও জোরালো হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফেডারেশনের পর্ষদ বাতিল করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাঁকে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত কমিটির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসক নির্বাচনের চেয়ে ফেডারেশনের সংস্কারে বেশি মনোযোগ দেন। ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি অনুযায়ী এ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ফলশ্রুতিতে নির্বাচন পিছিয়ে যায়।
সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “এফবিসিসিআই যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, গত দেড় দশক তা পূরণ করতে পারেনি। বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে ফেডারেশনের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য থাকবে না।” বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয় সংস্কার প্রত্যাশীদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে বিধিমালার কিছু ধারায় ব্যবসায়ীদের আপত্তি আছে। বিশেষ করে—ফেডারেশনের পর্ষদে সর্বোচ্চ দুইবার টানা থাকা যাবে। এরপর একবার বিরতি দিয়ে আবার নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এটি গত দুই মেয়াদের জন্যও প্রযোজ্য। অর্থাৎ গত দুই মেয়াদে যারা পর্ষদে ছিলেন তারা এবার নির্বাচন করতে পারবেন না। নিবন্ধন ফি ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সভাপতি, সহসভাপতি ও অন্যান্য পদ সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ ২৪ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত মে মাসে নতুন বিধিমালা জারি হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয় নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে তফসিল ঘোষণা করে। কিছু ব্যবসায়ী সভাপতি পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণা শুরু করলে একে একে সাতটি রিট মামলা হয়। মামলার কারণে নির্বাচন স্থগিত থাকে। প্রশাসকের মেয়াদ এক বছর পার হওয়ায় গত মাসে নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।
বারভিডার সভাপতি আবদুল হক বলেন, “ফেডারেশন নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সমস্যা কত গভীর তা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বুঝতে পারেননি। যারা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন, তারা সঠিক পরামর্শ দেননি। ফেডারেশনে বড় ধরনের সংস্কার দরকার ছিল। এজন্য গ্রহণযোগ্য জ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ীকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা উচিত ছিল।” সংশোধিত বিধিমালার নানা ধারা নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে মন্ত্রণালয় গত সেপ্টেম্বরে পুনরায় সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। তবে এখনও কাজ শেষ হয়নি।
এফবিসিসিআইয়ের নতুন প্রশাসক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খান বলেন, “চলতি মাসের মধ্যে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধনের কাজ শেষ হবে। সঙ্গে ফেডারেশনের নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ডও গঠন করা হবে।” নির্বাচনের সময় নির্ধারণ সম্পর্কে তিনি জানান, “সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।”
চেম্বার নির্বাচনে অবরুদ্ধতা, ভোট স্থগিত:
চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্ব নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১ নভেম্বর। কিন্তু দুই দিন আগে উচ্চ আদালত নির্বাচন দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। ২০১৩ সালের পর এই চেম্বারে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হয়নি। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেতৃত্ব পেয়ে আসছেন।
জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর এক ব্যবসায়ীর করা রিটের প্রেক্ষিতে নির্বাচন পরিচালনার আদেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। আদালত দুই শ্রেণিকে বাদ দিয়ে ভোট আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ২২ অক্টোবর মন্ত্রণালয় আপিল করে। শুনানি শেষে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল আদালত হাইকোর্টকে নির্দেশ দেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে রিট নিষ্পত্তি করতে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের মতো সিলেট চেম্বারের ভোটও ১ নভেম্বর হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনে দুটি প্যানেল থেকে মোট ৪২ জন প্রার্থী ছিলেন। তবে চেম্বারের একটি পক্ষের আবেদন পেয়ে ২৬ অক্টোবর মন্ত্রণালয় ভোট স্থগিত করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও নতুন তফসিল ঘোষণা করার নির্দেশ দেন। এরপর দুই প্যানেল আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত নির্বাচন আয়োজনের পথে কোনো বাধা নেই বলে নির্দেশ দিলেও নির্বাচন এখনও আয়োজন হয়নি।
ঢাকা চেম্বারের নির্বাচনেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ই-ক্যাবের নির্বাচন শেষ মুহূর্তে আদালতের রায়ে আটকে গেছে। নতুন বিধিমালার কারণে ঢাকা চেম্বারের বর্তমান পর্ষদের মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতিতাসকীন আহমেদ বলেন, “সংস্কারগুলো কোম্পানি আইনের আলোকে করা উচিত ছিল। তবে এফবিসিসিআই কেন্দ্রিক সংস্কারে অন্য বাণিজ্য সংগঠনকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে আমাদের নির্বাচন আটকে গেছে, যা অতীতে কখনো হয়নি।” ঢাকা চেম্বারের পরিচালনায় পর্ষদের মেয়াদ তিন বছর। প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য বাদ যান। কিন্তু নতুন বিধিমালায় পর্ষদের মেয়াদ দুই বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কারণে নির্বাচন বোর্ড গঠন করেও প্রক্রিয়াটি এগোয়নি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “ফেডারেশন গত দেড় দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারেনি। বর্তমানে যেভাবে চলছে, এভাবে চলতে থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য থাকবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনেও সমস্যা থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের অভিজ্ঞদের সঙ্গে বসে ১০-১২ দিনের মধ্যে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধন করা সম্ভব। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে এসব সংগঠনের নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব।”

