বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবকাঠামো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেওয়া হলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গতকাল দুইটি বড় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল এবং ঢাকার পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) ডেনমার্কের শিপিং জায়ান্ট এপি মোলার–মায়েরস্কের সহায়ক প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস এবং তাদের স্থানীয় অংশীদার কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিসেস লিমিটেডকে লালদিয়া টার্মিনাল পরিচালনার জন্য লেটার অব অ্যাওয়ার্ড (এলওএ) প্রদান করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী, এপিএম আগামী ৩০ বছর লালদিয়া টার্মিনাল ডিজাইন, নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, টার্মিনাল চালু করতে প্রথম তিন বছরে তারা ৫৫০ মিলিয়ন ডলার (৫৫ কোটি) বিনিয়োগ করবে। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চুক্তি স্বাক্ষরের কালি শুকানোর আগেই এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে ঘোষণা করেছিল, তারা আগের সরকারের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত চুক্তির পথে যাবে না। আগের সরকার বিদ্যুৎ খাতে এবং এফএসআরইউ স্থাপনের সময় জোরপূর্বক অস্বচ্ছভাবে এগিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান চুক্তিটিও একই অস্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতাবিহীন প্রক্রিয়ায় হয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় জড়িত সরকারের তিনটি সংস্থা—পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এবং বিডা—চুক্তির কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। এতে দরপত্র বিশেষজ্ঞ এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, লালদিয়া প্রকল্পে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই চুক্তি দেওয়া হয়েছে। যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং বিধিমালা ২০০৮-এর সরাসরি লঙ্ঘন।
একটি অনাকাঙ্ক্ষিত চুক্তি:
এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত চুক্তি, সরাসরি এবং স্পষ্টভাবেই তাই,” মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট ছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করা এবং গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে এমন দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, “সংস্কারের পরিবর্তে সরকার বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। এতে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সুবিধা পেতে পারে।” “আর মাত্র তিন মাস পরই জাতীয় নির্বাচন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল,” যোগ করেন তিনি।
জনগণের চুক্তির শর্ত জানার অধিকার রয়েছে: টিআইবি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, জি-টু-জি চুক্তি সরকার করতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও কিছু মানদণ্ড অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। বিদ্যমান আইনে জি-টু-জি চুক্তি প্রকাশ করা না গেলেও সরকারকে তা পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, “সরকার যখন সুবিধা মনে করবে, তখন এভাবে চুক্তি করবে। আবার যখন ইচ্ছা হবে, তখন বাতিল করবে—এভাবে করা যাবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, তা নিয়ে কাদের সঙ্গে কী ধরনের চুক্তি হচ্ছে, তা জানতে জনগণের অধিকার রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য হলেও চুক্তি প্রকাশ করা প্রয়োজন।”
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, “অতীতে জি-টু-জি চুক্তির আওতায় অনেক চুক্তি করা হয়েছে, যেখানে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান সরকার সেই ধরণের অনেক চুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই একই ধরনের চুক্তি এই সরকারের কাছ থেকে কাম্য নয়।” তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, ভারতের আদানির সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের করা জি-টু-জি চুক্তির অভিজ্ঞতা বর্তমান সরকারের সময় প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও কেন এই সরকার বন্দরে অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে একই পন্থা গ্রহণ করছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “পুরো চুক্তি প্রকাশ করা না হলেও অন্তত দুটি বিষয় জনগণের কাছে উন্মুক্ত করতে হবে। প্রথম, কোন প্রক্রিয়ায় বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়, অন্য কোনো অপারেটরকে বিবেচনা না করে কেন নির্দিষ্ট কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হলো—তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।”
নির্বাচিত সরকারই সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো:
চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ূন চৌধুরী বলেন, লালদিয়া টার্মিনাল ইজারার জন্য আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলে আরও ভালো হতো। তিনি আনু মুহাম্মদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, “নির্বাচন মাত্র তিন মাস দূরে। এমন সময়ে বন্দর টার্মিনাল লিজের মতো বড় সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।”
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, “সরকার চুক্তি স্বাক্ষরের আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। করলে আমরা আমাদের মতামত জানাতে পারতাম। আমরা নিশ্চিত নই চুক্তিতে স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে কি না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা জানি না জাতীয় স্বার্থ চুক্তিতে সুরক্ষিত হয়েছে কিনা। চুক্তির ছোট একটি ভুলও ভবিষ্যতে বড় জটিলতা তৈরি করতে পারে।” চুক্তি “বুলেট গতিতে” স্বাক্ষর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি এটিকে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বিদেশি অপারেটর নিয়োগে সরকারের যুক্তি:
ডেনমার্কের এপি মোলার–মায়েরস্কের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসের মাধ্যমে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ৫৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। এটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ইউরোপীয় প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং সবচেয়ে বড় পিপিপি প্রকল্পগুলোর একটি। গতকাল মায়েরস্ক গ্রুপ ও ডেনমার্ক সরকারের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লালদিয়া টার্মিনালে এপিএম-এর বিনিয়োগ বাংলাদেশের বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে নতুন যুগের সূচনা করবে।
সোমবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দুই পক্ষ চুক্তিতে সই করেন। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, “আমরা যদি প্রতিযোগিতাসক্ষম থাকতে চাই, প্রাসঙ্গিক থাকতে চাই— তাহলে আমাদের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। তাই দ্রুত বাজারে পৌঁছানোই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে এপিএম টার্মিনালসের মতো সুবিধা প্রয়োজন।”
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এপি মোলার–মায়েরস্কের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আমাদের বন্দর ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন জটিলতা সমাধানে সহায়তা করবে। আমরা তাদের স্বাগত জানাই।”
পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী আশিক চৌধুরী বলেন, “সরকারের ওপর কোনো ঋণ চাপানো ছাড়াই আমরা একটি বিশ্বমানের অপারেটর পাচ্ছি। এই টার্মিনাল চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।”
ভার্চুয়ালি দেওয়া বার্তায় ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন বলেন, “মায়েরস্ক বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের অংশীদার। আমাদের দুই দেশের মধ্য বিদ্যমান শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্কের অন্যতম চালিকাশক্তি। বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ কনটেইনারই মায়েরস্ক পরিচালনা করে। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে মায়েরস্ক–এপিএমটির এই বিনিয়োগ আমাদের স্থায়ী ও বাস্তব অংশীদারিত্বের শক্তিশালী প্রতীক।”
এপিএম টার্মিনালসের সিইও কিথ স্বেন্ডসেন বলেন, “আমরা নিরাপদ ও দক্ষ টার্মিনাল গড়ে তোলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এ অঞ্চলের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

