বাংলাদেশের সরকারি অর্থব্যবস্থায় চাপ ক্রমেই বাড়ছে। গত কয়েক অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে বিপুল বকেয়া পরিশোধের চাপ এবং কৃষি উপকরণের বাড়তি খরচ এই ব্যয় বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করেছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি খাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৬৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরের তুলনায় এই ব্যয় প্রায় ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিতে সরকার ব্যয় করেছিল ৭২ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। সর্বশেষ বাজেট তথ্য ও সংশোধিত প্রাক্কলন বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনার মোট বরাদ্দ সরকারি পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এটি অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
গত চার বছরে কৃষি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অন্যান্য কয়েকটি খাতে ভর্তুকি প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে। এতে সরকারের ওপর তৈরি হয়েছে বড় ধরনের আর্থিক চাপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার কর্মসূচির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। সেই অঙ্কই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৬৮ কোটি টাকায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৭০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। বৈশ্বিক জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৭২ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা।
এখনো সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে ব্যয় দ্রুত বাড়ছে মূলত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-এর আর্থিক সংকট সামাল দিতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত হিসাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। এই অর্থের বড় অংশই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে ব্যয় হবে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ এবং এলএনজি ও কয়লার মতো আমদানি করা জ্বালানির বাড়তি খরচে বিদ্যুৎ খাতে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে গড়ে প্রায় ৪ টাকা ৮০ পয়সা লোকসান গুনতে হচ্ছে বোর্ডকে। বিশ্বব্যাপী ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কৃষি খাতে সহায়তা বাড়িয়েছে। চলতি অর্থচক্রে কৃষি ভর্তুকির বরাদ্দ ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি করা হয়েছে।
এই অর্থের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সার আমদানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া এবং টাকার মান কমে যাওয়ায় কৃষকদের জন্য সার সাশ্রয়ী রাখতে সরকারকে বাড়তি মূল্য ব্যবধান বহন করতে হচ্ছে। ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক–এর মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ভর্তুকি ভোক্তাদের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির পুরো চাপ থেকে কিছুটা রক্ষা করলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারের আর্থিক সুযোগ সীমিত করে দিচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় ভর্তুকি বজায় রাখা এবং বাড়তে থাকা বাজেট ঘাটতি সামাল দেওয়ার মধ্যে সরকারকে খুব সতর্ক ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে।

