গাজার স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল। বৃহস্পতিবার এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি এটিকে ইসরায়েলের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরলেও, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনাকে একটি শর্তের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। সেই শর্ত হচ্ছে, গাজায় হামাসের হাতে আটক থাকা ১০১ ইসরায়েলি ও বিদেশি বন্দির মুক্তি এবং হামাসের অস্ত্র সমর্পণ।
নেতানিয়াহুর ভাষায়, “যদি হামাস তাদের অস্ত্র ফেলে এবং আমাদের বন্দিদের ফিরিয়ে দেয়, তবে এই যুদ্ধ শেষ হতে পারে।” কিন্তু এই বক্তব্যের পরেই যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সিনওয়ারের হত্যাকে সফল অভিযান হিসেবে তুলে ধরা হলেও হামাস এর প্রতিক্রিয়ায় আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সিনওয়ারের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে হামাসের ডেপুটি প্রধান খলিল আল-হাইয়া শুক্রবার বলেছেন, “ইসরায়েলি আগ্রাসন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে না।” তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের বাহিনী গাজা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
হামাসের এই কঠোর অবস্থানের কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ আরও বেড়ে গেছে। দুই পক্ষের হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। ইসরায়েলের ভেতরেও এ নিয়ে নানা মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। নেতানিয়াহুর কিছু রাজনৈতিক মিত্র বিশেষ করে কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সরাসরি বলেছেন, “হামাস পুরোপুরি আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত আমাদের থামা উচিত নয়।”
ইসরায়েলের এই কঠোর অবস্থান এবং হামাসের পাল্টা হুমকির মধ্য দিয়ে সংঘাতের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে তারা এখন সরাসরি যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে। মার্কিন প্রশাসন প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের নেতারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন। মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
বিশ্ব নেতৃত্বের কড়া বার্তা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়লেও ইসরায়েলের ভেতরে বিভিন্ন রাজনীতিক ও সামরিক নেতারা এখনও হামাসকে পুরোপুরি দমন করার পক্ষে। নেতানিয়াহুর ওপরও এখন প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলি সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে যেখানে কিছু মানুষ যুদ্ধের অবসান চায়, অন্যদিকে কট্টরপন্থীরা চান হামাসকে আরও কঠোরভাবে দমন করা হোক।
এদিকে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যার পর হামাসের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়েও জল্পনা চলছে। হামাসের নেতৃত্বে এখন কে আসছেন এবং তিনি কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ যে কোনও দিকে মোড় নিতে পারে এবং হামাসের নতুন নেতার কৌশল সেটিই নির্ধারণ করবে। সিনওয়ারের মতো কঠোর নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে নাকি কৌশলগত পরিবর্তন আসবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে একদিকে ইসরায়েলের চাপ এবং অন্যদিকে হামাসের প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি—এই দুইয়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এখন এক ক্রান্তিকালের মুখে।
বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের অবসান শিগগিরই হতে যাচ্ছে না। বরং ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড এবং বন্দিমুক্তির শর্ত নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত এবং রক্তক্ষয়ী করে তুলতে পারে।