মহাসাগরগুলি পৃথিবীর প্রাণপ্রবাহ কিন্তু বর্তমানে তারা একটি ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। প্লাস্টিক দূষণ একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পরিবেশ, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে।
প্রতি বছর আনুমানিক ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য মহাসাগরে চলে যায়। এই প্লাস্টিকের প্রায় ৭০% মাটিতে বা জলে ভেসে থাকে যা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী দশকে মহাসাগরে প্লাস্টিকের পরিমাণ জীবনের জন্য বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
মহাসাগরীয় প্লাস্টিক দূষণের প্রধান প্রভাব হলো সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। প্লাস্টিকের টুকরো যেমন মাইক্রোপ্লাস্টিক মাছ, তিমি এবং অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্য চেইনে প্রবেশ করে, যার ফলে মানবদেহেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া প্লাস্টিকের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রের জলজ পরিবেশকে দূষিত করছে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার ও সংস্থা প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (COP21) প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বহু দেশ একসাথে মিলিত হয়ে “মহাসাগর বাঁচাও” কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
মহাসাগরীয় প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলার জন্য বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চলছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ও উদ্যোগের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। ২০১৭ সালে “বহুবিধ জাতি প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য” একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে, যেখানে ১২০টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎস খুঁজে বের করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
বৈশ্বিক পরিসরে সার্কেল ইকোনমি বা “গোলাকার অর্থনীতি” মডেল প্রবর্তিত হয়েছে, যেখানে পুনর্ব্যবহার, পুনঃব্যবহার এবং পুনঃনির্মাণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই মডেল অনুসরণ করে প্যাকেজিং আইন পরিবর্তন করছে এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য নীতি গ্রহণ করছে।
বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানিগুলি যেমন কোকা-কোলা, নেসলে এবং ইউনিলিভার প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর অঙ্গীকার করেছে। তারা ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের প্যাকেজিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পুনঃব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
কিছু দেশ, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কানাডা, একযোগে প্লাস্টিকের এক-বারের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। ২০২১ সালে, ইউরোপীয় কমিশন একাধিক প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা বিশেষ করে সমুদ্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিকের স্বাস্থ্য প্রভাব নির্ধারণের জন্য গবেষণা পরিচালনা করছে। এ ধরনের গবেষণা আইন প্রণয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও এবং সংগঠন, যেমন “সেভ দ্য কোস্ট” ও “ওশান কনসার্ভেন্সি”, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। তারা শিক্ষা ও প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করছে।
বিশ্বজুড়ে সমুদ্র পরিষ্কার অভিযানে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে। “ওশান ক্লিনআপ” এবং “প্লাস্টিক ব্যাঙ্ক” এর মতো প্রকল্পগুলি সমুদ্র থেকে প্লাস্টিক অপসারণে সহায়তা করছে এবং পুনর্ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে।
স্থানীয় পর্যায়েও অনেক সংগঠন কাজ করছে। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে প্লাস্টিক সংগ্রহ অভিযান, সচেতনতা সৃষ্টি এবং পুনর্ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে প্লাস্টিক ব্যবহারের সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।
মহাসাগরীয় প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলার জন্য দরকার একটি সমন্বিত এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা। সরকার, সংস্থা, এবং সাধারণ জনগণের যৌথ উদ্যোগে সচেতনতা বাড়ানো এবং আইন প্রণয়ন জরুরি। পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার, প্লাস্টিক কমিয়ে আনা এবং তথ্য প্রচারের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।
মহাসাগরীয় প্লাস্টিক দূষণ আমাদের সময়ের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এই সংকট মোকাবেলার জন্য সমগ্র বিশ্বকে একত্রিত হতে হবে। যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের মহাসাগরগুলি কেবল একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমাদের অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে মহাসাগরের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হয়।