বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় সংকট হল শরণার্থী সমস্যা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৮ কোটি মানুষ বর্তমানে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করছে- যাদের বেশিরভাগই যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন এবং রাজনৈতিক সংকটের শিকার।
এ অবস্থায় মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নটি গুরুত্ব সহকারে সামনে এসেছে।
মানবাধিকারের মূল চেতনায় প্রত্যেক মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং আত্মমর্যাদা সংরক্ষণে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন এখনও অনেক ক্ষেত্রে অপ্রতুল।
শরণার্থীদের অবস্থান ও বৈশ্বিক সংকট-
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ থেকে প্রচুর মানুষ যুদ্ধের কারণে ঘর ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়া, ইয়েমেন এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। তারা বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে, কখনো আবার খোলা আকাশের নিচে, অনিরাপদ ও মানবেতর পরিবেশে জীবনযাপন করছে। শুধুমাত্র সিরিয়া থেকেই প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর চাপ নিকটবর্তী দেশগুলির ওপর পড়েছে। বিশেষ করে তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানের মতো দেশগুলির উপর। তাদের নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থা তেমন শক্তিশালী নয়। এর ফলে, শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার, চিকিৎসা এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে উঠেছে কষ্টকর।
মানবাধিকারের সংকট-
শরণার্থীদের অধিকার রক্ষা করা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল দায়িত্ব হলেও বাস্তবে এর বাস্তবায়নে ঘাটতি লক্ষ করা যায়। শরণার্থী শিবিরগুলোর দুর্দশা এবং তাদের নিরাপত্তার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই শরণার্থীদের মৌলিক অধিকার যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীরা যৌন হয়রানি এবং নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে। যা মানবাধিকারের সম্পূর্ণ অবমাননা।
বিশ্ব মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার এবং নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চার অধিকার আছে। কিন্তু শরণার্থীদের ক্ষেত্রে এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা-
শরণার্থী সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলি আর্থিক সহায়তা এবং নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সেটি যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশগুলির উচিত শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করা। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দেশ যেমন কানাডা, জার্মানি এবং সুইডেন কিছু সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দান করেছে। কিন্তু এই সংকট মোকাবিলার জন্য আরো বৃহত্তর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কেবল অর্থনৈতিক সহায়তাই নয় বরং নৈতিক সহায়তার দিকটিও জরুরি।
মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিকদের দায়িত্ব-
শরণার্থী সমস্যায় সাধারণ নাগরিকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে এবং সাধারণ নাগরিকদের উচিত এই প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করা। তাদের আর্থিক সহায়তা, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং শরণার্থীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশের মাধ্যমে সমাজে একটি সহানুভূতিশীল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আন্তর্জাতিক সমাজে বৈষম্যহীনতার প্রসার এবং সহনশীলতার চর্চা এই সংকটের কিছুটা হলেও সমাধানে সহায়ক হতে পারে।
শরণার্থী সংকটের সমাধান করতে হলে আন্তর্জাতিক সমাজের মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। শরণার্থীদের দুর্দশা শুধুমাত্র একটি আর্থসামাজিক সংকট নয় বরং এটি মানবাধিকারের একটি গুরুতর সমস্যা। এ কারণে প্রত্যেক দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সাধারণ নাগরিকদের উচিত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসা।
শরণার্থীদের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা মানবাধিকারের প্রতি এক ধরনের দায়িত্ব। তাই, এই সংকটকে বৈশ্বিক একতার মাধ্যমে মোকাবিলা করা জরুরি। শরণার্থীদের সহায়তায় মানবাধিকার সংস্থাগুলি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে একটি বাস্তবসম্মত এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রণয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে এই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান সম্ভব হবে।
বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকট আজ এক ভয়াবহ বাস্তবতা। যুদ্ধ, রাজনৈতিক উত্তেজনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক সংকট মিলিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশের সীমানা ছাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি মানুষ শরণার্থী, আর এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এর ফলে মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নটি আরও বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে। পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশন সংবাদে প্রতিনিয়ত শরণার্থীদের দুর্দশা আমাদের সামনে উঠে আসে। অথচ বাস্তবে তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও, তা প্রায়শই কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে।
শরণার্থীদের বাস্তবতা: সংকটের পটভূমি-
শরণার্থী সমস্যার মূলে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো যেমন সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে বিপুল মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ যেমন কয়েক লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, তেমনি আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের প্রেক্ষাপটেও বহু মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে দেশত্যাগ করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক সংকটের কারণে বহু মানুষ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার কিছু দেশেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে।
মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও শরণার্থীদের দুর্দশা-
মানবাধিকার রক্ষার মৌলিক নীতিগুলো প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি মানবাধিকারের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র প্রকাশ করছে। শরণার্থীদের জন্য নির্ধারিত শিবিরগুলোতে অপ্রতুল খাদ্য, পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার অভাব তাদের জীবনকে অনিরাপদ ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। শরণার্থী শিবিরগুলিতে অত্যন্ত জনবহুল অবস্থা এবং প্রায়ই সেই পরিবেশটি স্বাভাবিক মানবিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে চলে যায়।
নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও গুরুতর। শরণার্থী শিবিরে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন এবং নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। আর শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা ভবিষ্যতের জন্য কোনো ধরনের দক্ষতা গড়ে তুলতে পারে না, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরো অনিশ্চিত করে তুলছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
মানবিকতার দৃষ্টিকোণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা-
শরণার্থী সংকটের মানবিক দিকটি বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও কার্যকর উদ্যোগ প্রায়শই প্রয়োজনের তুলনায় কমই দেখা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং উন্নত দেশগুলো কিছু কিছু শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। তুরস্ক, জর্ডান এবং লেবাননের মতো দেশগুলো সীমিত সম্পদের মধ্যে প্রচুর শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেই এটি স্থায়ীভাবে বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠছে।
বিশ্ব মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেকেরই নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। এই অধিকার বাস্তবায়ন করতে আন্তর্জাতিক সমাজের পাশাপাশি দেশীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোরও কার্যকর ভূমিকা রাখা জরুরি।
মানবাধিকার সংগঠন ও সাধারণ নাগরিকের ভূমিকা-
মানবাধিকার রক্ষায় কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (UNHCR) এবং বিভিন্ন এনজিও শরণার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ নাগরিকদেরও উচিত শরণার্থী সমস্যার সমাধানে সহায়তা করা। আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব রয়েছে এই উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে একটি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যা শরণার্থীদের প্রতি বৈষম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে সহায়ক হবে।
শরণার্থী সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। জাতিসংঘের মতো সংস্থার উচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলির উচিত শরণার্থীদের একটি স্থায়ী আশ্রয় প্রদানের প্রস্তাব গ্রহণ করা। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো এই সংকট নিরসনে আরও জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে পারে।
শরণার্থী সংকট নিরসনে মানবিকতার সঙ্গে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের প্রয়োজন। শরণার্থীদের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার এবং সম্মান নিশ্চিত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট মোকাবিলায় একজোট হতে হবে এবং একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে।
আজকের শরণার্থী সংকট শুধু একটি আর্থসামাজিক সমস্যা নয় বরং মানবাধিকারের প্রয়োজনীয়তাকে নতুন করে উপলব্ধি করার উপলক্ষ্য। শরণার্থী সংকটকে মানবতার সংকট হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।