মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক প্রস্তাব নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা নিয়ে তার পরিকল্পনা ইসরাইল ছাড়া প্রায় সব দেশকেই ক্ষুব্ধ করেছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, তারা ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। কারণ এটি বাস্তবসম্মত নয়।
গাজা পুনর্গঠনের জন্য যে বিশাল অর্থ ও জনবল প্রয়োজন, তা ট্রাম্পের প্রশাসন বিনিয়োগ করবে বলে মনে হয় না। বরং তার ব্যয় সংকোচন নীতির দিকে নজর দিলে বোঝা যায়, তিনি এমন কোনো প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করবেন না। তবে বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে চাইছেন।
মার্কিন প্রচলিত পররাষ্ট্রনীতির অনেক কিছুই ট্রাম্প অনুসরণ করেননি। তার প্রথম মেয়াদে তিনি ইসরাইলে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যান। যা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। ফিলিস্তিনিরা আশা করে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একদিন তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক ইসরাইলি হামলার পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ইসরাইলের পাল্টা হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে দেয়।
এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও ফিলিস্তিনিদের সৌদি আরবে বসবাসের সুযোগ দেওয়ার একটি প্রস্তাব দেন। যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আরও উত্তেজনা বাড়ায়। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তারা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে অটল থাকবেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিন সালমান ট্রাম্পের প্রস্তাবের সরাসরি সমালোচনা করেননি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। যা তিনি এখনই ঝুঁকির মুখে ফেলতে চান না।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা শুধু সৌদি আরব নয় বরং তার ঘনিষ্ঠ মিত্র মিশর ও জর্দানের জন্যও বেশ বিব্রতকর। দেশ দুটি এখনো নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায়, বর্তমান পরিস্থিতিতেও নতুন শরণার্থীদের গ্রহণ করা তাদের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘গাজাবাসীকে বাস্তুচ্যুত করা মেনে নেওয়া হবে না। কারণ এটি মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।’
জর্দানের বাদশাহ আব্দুল্লাহও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ডে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’ ১১ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প ও আব্দুল্লাহর মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক চলাকালেই ট্রাম্প সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি দেন। যাতে বাদশাহ আব্দুল্লাহ অপ্রস্তুত অবস্থায় কোনো মন্তব্য করেন। তবে তিনি কূটনৈতিকভাবে এমন উত্তর দেন। যাতে তার অবস্থান স্পষ্ট না হয়।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক নেইল কুইলিয়ামের মতে, মিশর ও জর্দানের মতো দেশগুলোর আশঙ্কা হলো—একবার ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিলে তাদের আর ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আম্মানভিত্তিক বিশ্লেষক ক্যাটরিনা সামুর মতে, এটি ১৯৪৮ সালের বাস্তুচ্যুতির পুনরাবৃত্তি। সেই স্মৃতি এখনো ফিলিস্তিনিদের মনে গেঁথে আছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য গবেষক আলিয়া ব্রাহিমি বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধের প্রবণতা থাকে। যদি ফিলিস্তিনিরা মিশরে আশ্রয় নেয়, তাহলে তারা স্থানীয় মিলিশিয়াদের সঙ্গে মিশে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এতে শুধু ট্রাম্পের পরিকল্পনাই ব্যর্থ হবে না বরং মিশর-ইসরাইল শান্তিচুক্তিও বিপর্যস্ত হতে পারে।’
অন্যদিকে মিশর ও জর্দান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। তাই ট্রাম্পের পরিকল্পনা অর্থনৈতিকভাবে তাদের জন্য আকর্ষণীয় হলেও নিরাপত্তার দিক থেকে এটি ঝুঁকিপূর্ণ।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে এতে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। সৌদি আরব, মিশর ও জর্দানের মতো দেশগুলো একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থও রক্ষা করতে চায়। ফলে ট্রাম্পের প্রস্তাব পুরো অঞ্চলকে এক ধরনের কূটনৈতিক দোটানায় ফেলে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনগুলোতে এই সংকট কীভাবে গতি পরিবর্তন করে।