ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ও ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। প্যারিসে আয়োজিত একটি জরুরি নিরাপত্তা সম্মেলন এই পরিস্থিতির গুরুত্বই ফুটিয়ে তুলেছে। ইউরোপের নেতারা ক্রমশ উপলব্ধি করছেন যে, এই সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে তারা অনেকটাই বাদ পড়ে গেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে তিনি শিগগিরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। তবে ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো নিশ্চিত নয়। তারা কি একসঙ্গে থেকে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে কোনো কার্যকর কৌশল নিতে পারবে?
বিশেষ করে, ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনের মতো বড় সিদ্ধান্ত কি তারা নিতে পারবে? এটি কেবল সামরিক পদক্ষেপ নয় বরং কূটনৈতিক আলোচনার টেবিলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার একটি কৌশল হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, তার দেশ ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত এবং এই বিষয়ে তারা প্রয়োজনীয় পরিকল্পনাও করছে। অন্যদিকে, জার্মানির আসন্ন নির্বাচনের আগে সিডিইউ পার্টির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির আওতায় থেকে তারা বিদেশে সৈন্য মোতায়েনের বিষয়ে আগ্রহী।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন ধরনের বার্তা আসছে। যা ইউরোপের জন্য অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের সামনে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে পারে যে, ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনা থেকে তাদের বাদ রাখা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। প্যারিস সম্মেলনে ইউরোপের নেতারা দুটি প্রধান বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন- প্রথমত প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয়ত যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করা।
তবে ইউরোপীয় নেতারা এটাও নিশ্চিত করতে চাইছেন যে, যেকোনো আলোচনা থেকে ইউক্রেনকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের মতে, ইউক্রেনকে সরিয়ে রেখে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা হলে সেটি টেকসই কোনো সমাধান আনতে পারবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ের ওপর নির্ভরশীল থেকেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পুতিন বরাবরই ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে এসেছেন। এর ফলে পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এবং রাশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ নিজেদের অনিরাপদ মনে করতে পারে।
প্যারিস সম্মেলনে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। এতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, স্পেন ও ডেনমার্কের মতো দেশগুলো অংশ নেবে, যারা প্রতিরক্ষার দিক থেকে শক্তিশালী। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ও ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেলও উপস্থিত থাকবেন। তবে অন্যান্য দেশগুলো পরবর্তী বৈঠকে অংশ নেবে বলে জানা গেছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে ঐকমত্য আসা সহজ হবে না। পোল্যান্ড ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, তারা ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপির ৪.৪৭% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে। কিন্তু যুক্তরাজ্য এখনো ২.৫% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
তবে নেতারা প্রতিরক্ষা বাজেট সমন্বয়ের পাশাপাশি ন্যাটোর ব্যয় বৃদ্ধি ও যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেন পুনর্গঠনে আরও বেশি ভূমিকা রাখার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রতিরক্ষা উদ্যোগ আরও জোরদার করতে চায়।
এদিকে, প্যারিস সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনে সেনা পাঠানো হবে কি না? প্রস্তাবিত এই বাহিনীকে ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ বলা হচ্ছে না বরং এটি হবে ‘আশ্বস্তকরণ বাহিনী’। যারা সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি রেখার ভেতরে অবস্থান করবে।
ইউরোপীয় সৈন্য মোতায়েনের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে—
- ইউক্রেনের জনগণকে আশ্বস্ত করা যে তারা একা নয়।
- যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেওয়া যে ইউরোপ তার প্রতিরক্ষা দায়িত্ব নিজেই নিচ্ছে।
- মস্কোকে সতর্ক করা যে যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করলে রাশিয়াকে কেবল কিয়েভের সঙ্গে নয়, ইউরোপের সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হবে।
তবে এই পরিকল্পনার কিছু বিতর্কিত দিকও রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশের জনগণ সেনা পাঠানোর বিরুদ্ধে। ইতালির জনমত জরিপ বলছে, ৫০% মানুষ ইউক্রেনে নতুন করে অস্ত্র পাঠাতেও নারাজ। সেখানে সেনা পাঠানোর বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর হতে পারে।
এছাড়া, ইউরোপের সেনা সংখ্যা কত হবে, তারা কতদিন অবস্থান করবে, তারা কোন কমান্ডের অধীনে থাকবে—এসব প্রশ্নের এখনো সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, রাশিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করলে ইউরোপীয় সেনারা কী করবে? তারা কি সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে? যদি তাই হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপের পাশে থাকবে?
ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তা’ চাইছে। তবে তারা তা পাবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমারসহ অন্যান্য ইউরোপীয় নেতারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়েও উদ্বিগ্ন। ব্রিটেনের সাবেক সেনাপ্রধান লর্ড ডানেট মনে করেন, ইউক্রেনে সেনা পাঠালে যুক্তরাজ্যকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য দিতে হবে। যা এক লাখ পর্যন্ত হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিষয়ে মনোযোগ দেবেন কি না? উত্তর কঠিন। প্যারিস সম্মেলনের পর ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে।
এর মধ্যে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, স্যার কিয়ের স্টারমারেরও শিগগিরই ওয়াশিংটন সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। যা যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।
ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ের তিক্ততা ভুলে ইউরোপের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়তে চায় যুক্তরাজ্য। ফ্রান্সও ইউরোপের প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে ছয়টি প্রশ্নসহ একটি নথি পাঠিয়েছে। যেখানে ইউক্রেন সংকটের পরবর্তী ধাপে সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্যারিস সম্মেলনে ইউরোপের নেতারা যাই আলোচনা করুক না কেন, তাদের মূল চ্যালেঞ্জ হবে ইউক্রেন সংকটে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই বিষয়ে পিছু হটে, তাহলে ইউরোপকে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই আরও শক্তিশালী করতে হবে।
আর এক্ষেত্রে ট্রাম্পের দৃষ্টি যেদিকে থাকুক না কেন, পুতিনের নজর যে ইউরোপের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর থাকবে তা নিশ্চিত।