কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল এক ভয়াবহ হামলা হয়। পর্যটকদের ওপর চালানো এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। আহত হন অনেক মানুষ। হামলার পর ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। ভারতীয় নিরাপত্তা কমিটি (CCS) জরুরি বৈঠক করে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা কমিটিও একযোগে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায়। এই পদক্ষেপগুলো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুই দেশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ-
হামলার পর ভারতের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা কমিটি বৈঠকে বসে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি আপাতত স্থগিত করা হবে। পাকিস্তানের নাগরিকদের সার্ক ভিসা বাতিল করা হয়। অট্টারি-ওয়াঘা সীমান্ত স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়। এছাড়া পাকিস্তানে কর্মরত ভারতীয় পরমাণু উপদেষ্টা ও কূটনীতিকদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বিমানবন্দর ও নৌসীমায় কড়া নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে। পাকিস্তান সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণাও দেওয়া হয়।
পক্ষান্তরে পাকিস্তান সরকার জানায়, যদি ভারত সিন্ধুর পানি বন্ধ করে দেয়, সেটি হবে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য। এরপরই পাকিস্তান ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। সব ধরনের ট্রানজিটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতীয় সার্ক ভিসাধারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতীয় সামরিক উপদেষ্টাদের দেশছাড়া ঘোষণা করা হয়। আকাশপথেও ভারতীয় বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণাও আসে। পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দেয়, ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করলে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করা হবে। এসব পদক্ষেপ সীমান্তে নতুন করে নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে।
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ও তার প্রভাব-
সিন্ধু নদী ভারত ও পাকিস্তান, উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে দুই দেশ এই চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী হিমালয়ের ছয়টি নদীর পানি দুই দেশ ভাগ করে নেয়। যুদ্ধ, উত্তেজনা বা সংকটকালেও এই চুক্তি টিকে ছিল। কিন্তু এবার ভারত এই চুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। এতে পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা বলেছে, কেউ যদি পূর্বদিকের নদীর পানি আটকে দেয়, সেটি যুদ্ধের কারণ হতে পারে।
মার্কিন বিশ্লেষক হাসান আব্বাস বলেন, পানি নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন সাধারণ মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কৃষক, শ্রমিকসহ লাখো মানুষের জীবনে এর প্রভাব পড়বে। শিল্প, কৃষি, পানির ব্যবস্থা সব কিছুতে সংকট দেখা দেবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা দরকার হবে।
সিমলা চুক্তি ও এর আইনগত প্রভাব-
১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তান সিমলা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এতে সীমান্তরেখা (LoC) নির্ধারিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ খোলা ছিল। কিন্তু এবার পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, যতক্ষণ ভারত ক্ষমা না চাইবে এবং সীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ না করবে, ততক্ষণ সব চুক্তি স্থগিত থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে। কারণ একতরফাভাবে এমন চুক্তি বাতিল করা যায় না। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছিল। তবে যদি বাস্তবে চুক্তি মানা না হয়, তাহলে সীমান্তে সহিংসতা বাড়তে পারে। সম্প্রতি সীমান্তে গোলাগুলির খবর এই শঙ্কাকে সত্যি করছে।
কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান-
ভারত বলছে, এই হামলার পেছনে রয়েছে সন্ত্রাসী যোগসূত্র। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এর পেছনে ‘ক্রস-বর্ডার’ সন্ত্রাস আছে। ভারত তদন্ত চালাচ্ছে এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, এটি একটি স্থানীয় হামলা। ভারত নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে মিথ্যা বলছে। পাকিস্তানের সংসদে প্রস্তাব পাস হয়েছে, যেখানে ভারতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে।
পাকিস্তান আরো বলছে, কাশ্মীর এখনো একটি অসমাপ্ত ইস্যু। তারা জাতিসংঘের রেজুলেশন অনুযায়ী কাশ্মীরিদের স্বাধিকার সমর্থন করে। অন্যদিকে ভারত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাচ্ছে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে। পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পেতে কাজ করছে। তাই এখন দুই দেশের কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদ বনাম কাশ্মীরের গণআন্দোলন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলা দুই দেশের পুরনো শত্রুতা নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। চেথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিজ বাফাই বলেন, এটি ২০১৯ সালের পর সবচেয়ে বড় হামলা। ফলে সামরিক উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। পরমাণু অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমছে না।
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। ড্রোন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানও নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করছে। কেউ যদি মধ্যস্থতা না করে, তাহলে দুই দেশ নিজের মতো উত্তেজনা সামাল দিতে চাইবে। কিন্তু পরমাণু যুদ্ধের ভয় তাদের সীমিত রাখবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষ বাড়বে। পুরনো নির্ভরতা ভেঙে পড়বে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের সংঘর্ষের দিকে এগোতে পারে।
ভবিষ্যৎ আশঙ্কা ও করণীয়-
এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক খুবই নাজুক। সীমান্তে গোলাগুলি, চেকপোস্টে উত্তেজনা ও নানা নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে খারাপ করছে। যদিও যুদ্ধের সম্ভাবনা কম, তবুও অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ ঘটতে পারে।
উত্তেজনা কমাতে দরকার মধ্যস্থতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দুই দেশের মিত্ররা যদি শান্তির জন্য কাজ করে, তাহলে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। না হলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে।